ভয়ঙ্কর মাদক ক্রিস্টাল মেথ: ২০ পয়েন্ট দিয়ে আসছে দেশে, ১১ রুটে বিস্তার

মিনহাজুল ইসলাম, বাংলানিউজ :

ইয়াবা কারবারিরা এখন ক্রিস্টাল মেথ (আইস) ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। চিহ্নিত ইয়াবা মাফিয়াদের হাত ধরে ইয়াবার পাশাপাশি এখন দেশে ভয়ংকর মাদক আইসের চালান আসছে মিয়ানমার থেকে।

এ মাদক বহনে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হচ্ছে বেশি।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে ক্রিস্টাল মেথের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

নিয়মিত ইয়াবা আনার সুবাদে গত তিন বছর ধরে আইস কারবারির সম্পর্ক হয় এ দেশের মাদক কারবারিদের। সারা দেশে আইসের চাহিদা বাড়ায় অনেক ইয়াবা কারবারিরা এখন আইসের ব্যবসা করছেন।

চাহিদা ও লাভ দুটোই বেশি এবং ধরা পড়ার ঝুঁকি কম থাকায় আইসের ব্যবসাতে ঝুঁকে পড়েছেন তারা। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ায় খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের মাথাব্যথা বেড়েছে এ নতুন মাদক নিয়ে।

যে পথে আগে ইয়াবা আসতো ওই পথে এখন আসছে আইস।

জানা গেছে, মাদকের রাজধানী হিসেবে খ্যাত মিয়ানমারের সান স্টেট থেকে সাত আন্তর্জাতিক রুট হয়ে কমপক্ষে ২০টি পয়েন্ট দিয়ে দেশে প্রবেশ করছে ক্রিস্টাল মেথ। কমপক্ষে ১১টি আভ্যন্তরীণ রুট হয়ে ক্রিস্টাল মেথের চালান ছড়িয়ে পড়ছে দেশে। ক্রিস্টাল মেথের যোগানের নেপথ্যে রয়েছে দেশি-বিদেশি অর্ধশতাধিক চক্র। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থার একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ক্রিস্টাল মেথ পাচারের আদ্যপান্ত।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দেয়া তথ্যে মতে, বাংলাদেশের ক্রিস্টাল মেথ পাচারে নেপথ্যে রয়েছে মিয়ানমার ভিত্তিক এবং দেশীয় অর্ধশতাধিক চক্র। যার মধ্যে মিয়ানমারের সান স্টেট থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত ক্রিস্টাল মেথের চালান পাচারের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে সাতটি গ্রুপটি। যার মধ্যে রয়েছে সান স্টেট ভিত্তিক বিচ্ছিনতাবাদী গ্রুপ ইইনাইটেড স্টেট আর্মি, আরাকান আর্মি, কয়েকটি মিলিশিয়া বাহিনী অন্যতম। বাংলাদেশে অভ্যন্তরে এ ভয়ঙ্কর মাদক পাচারে রয়েছে কয়েকজন চিহ্নিত রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি মাদক কারবারি ।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর টেকনাফ জোনের সহকারী পরিচালক মো. সিরাজুল মোস্তফা মকুল বলেন, ইয়াবা কারবারিরা মূলত আইসের কারাবার পরিচালনা। গত তিন বছর ধরে দেশে আইস আসলেও এখনো যথেষ্ট বাজার তৈরি হয়নি। দেশের ৯০ ভাগ আইস রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সারাদেশে ছাড়িয়ে পড়তেছে। মিয়ারমার থেকে আইস আসলে সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রথমে চলে যায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে গুদাম ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে আইসের দাম পরিশোধ করে থাকে।

অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশি মাদক কারবারিরা ইয়াবা বা মূল্য পরিশোধের জন্য বেছে নিচ্ছে দুবাই, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরকে। বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে বড় বড় ডিলাররা ইয়াবা ও আইসের দাম পরিশোধ করে থাকে। হুন্ডির মাধ্যমে সেই টাকাই ডলার হয়ে চলে যাচ্ছে মিয়ানমারে। এভাবেই বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে। এছাড়া ওষুধ, স্বর্ণালঙ্কারসহ বিভিন্ন পণ্যের বিনিময়েও নিয়ে আসা হচ্ছে মাদক।

অনুসন্ধান ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, লাওস, থাইল্যান্ডসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভয়ঙ্কর এ মাদক পাচার হয় সান স্টেট থেকে। সান স্টেট থেকে কমপক্ষে সাতটি আন্তর্জাতিক রুট হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ক্রিস্টাল মেথ। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ২০ পয়েন্ট দিয়ে তা দেশে প্রবেশ করছে। সীমান্ত এলাকা থেকে নৌসহ কমপক্ষে ১১টি রুট দিয়ে ক্রিস্টাল মেথ ছড়িয়ে পড়ছে দেশে। কক্সবাজারের এসব স্পট দিয়ে প্রবেশ করা ক্রিস্টাল মেথের চালান ৭টি আভ্যন্তরীণ রুট দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাচার হয়। এ রুটগুলোর মধ্যে রয়েছে টেকনাফ-উখিয়া-মরিচ্যা-লিংকরোড-কক্সবাজার-রামু, টেকনাফ-উখিয়া-রেজুখাল ব্রিজ-কক্সবাজার-রামু হয়ে চট্টগ্রাম, গর্জনীয়-নাইক্ষ্যংছড়ি-রামু চা বাগান-ঈদগাঁও হয়ে চট্টগ্রাম, সোনাইছড়ি-পাঞ্জেখানা বাজার-রামু হয়ে চট্টগ্রাম। নৌপথে চার রুট হচ্ছে সেন্টমার্টিন-সোনদিয়া-মহেশখালী-বদরখালী-চকোরিয়া-পেকুয়া হয়ে চট্টগ্রাম। ক্রিস্টাল মেথ পাচারের অপর রুটটি হচ্ছে মহেশখালী-কুতুবদিয়া-আনোয়ারা হয়ে বাঁশখালী। সেন্টমার্টিন-ভাসানচর হয়ে বরিশাল এবং সেন্টমার্টিন-ভাসানচর হয়ে ঢাকা।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বিগত সময়ে ক্রিস্টাল মেথসহ গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য এবং বিভিন্ন সোর্সের পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মাদক পাচারের রুটগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে মাদক পাচারের হোতাদের বিষয়েও তথ্য পাওয়া যায়। সোর্সের মাধ্যমেও পাওয়া তথ্যেও ক্রিস্টাল মেথের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার উঠে আসে। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সোমেন মন্ডল বলেন, ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারীদের কেউ কেউ এখন ক্রিস্টাল মেথ পাচারের সাথে সম্পৃক্ত। আমরা তাদের চিহ্নিত করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। ক্রিস্টাল মেথের আন্তর্জাতিক এবং আভ্যন্তরিণ রুট চিহ্নিত করতে কাজ করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ক্রিমিনালাইজেশন অব পলিটিক্স এবং পলিটিসাইজেশন অব ক্রিমিনালদের মিথক্রিয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যরা আইস কারবারের সঙ্গে জড়িত। যার কারণে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সরকারের মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি যথার্থ বাস্তবায়ন ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে আইস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

আরও খবর