বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও একজন সবুজ বিপ্লবের ফেরিওয়ালা

 

বিপ্লব একটি অতিপরিচিত কিন্তু শিহরণ জাগানিয়া শব্দ। যার আবেদন কিংবা ব্যাপকতা বিশাল। বহুমাত্রিক এই শব্দটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। রাজনৈতিক বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব, কৃষি বিপ্লব, সবুজ বিপ্লব সহ নানাবিধ বিপ্লব আমারা দেখেছি অথবা ইতিহাস পড়ে জেনেছি।

সবুজকে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দিতে, প্রতিটি মাঠ, ঘাট প্রান্তর সবুজে সবুজে ভরে দিতে স্ব উদ্যোগে, নীরবে, নিভৃতে কাজ করে যাওয়া তেমনই এক সবুজ বিপ্লবী, নাম তাঁর তুষার চক্রবর্তী।

Habitate for Humanity International নামক একটি এনজিও -র ব্যবস্থাপক হিসেবে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় বর্তমানে কর্মরত জনাব তুষারের জন্ম যশোরে। বলতে গেলে বেড়ে উঠা কিংবা শৈশব, কৈশোর পুরোটাই কেটেছে যশোরে।

ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রকৃতিপ্রেমী। সবুজ বন বাদাড়, গাছগাছালি, সবুজে ঘেরা পাহাড়, ফুল এসবের সাথে তার সখ্যতা সেই শৈশব থেকেই। নিজ বাড়ি ভিটার এমন কোন অংশ নেই যেখানে তিনি ফলজ, বনজ বৃক্ষ অথবা ফুলের চারা রূপন করেননি। কিশোর বয়সে তিনি ফুলের বাগান করেছেন, রোপন করেছেন অজস্র গাছ যা ছিলো প্রকৃতি ও ফুলের প্রতি তার প্রেম -ভালোবাসা কিংবা শখের বসেই তিনি এসব করেছেন। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে তিনি যা করছেন তা সেই প্রেম-ভালোবাসাকেও ছাড়িয়ে যাবে।

তিনি এখন প্রেমে পড়েছেন অনাগত প্রজন্মের। ভবিষ্যত প্রজন্ম কিভাবে বেড়ে উঠবে, আমাদের সন্তানদের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী আমরা রেখে যেতে পারবো কী না, প্রকৃতির বিরূপ আচরণ থেকে অনাগত ভবিষ্যত কিভাবে রক্ষা পাবে কিংবা পরিবর্তীত পরিস্থিতির সাথে কিভাবে অভিযোজিত হওয়া যায় সেসব নিয়েই তাঁর আবেগ, কল্পনা, চিন্তা এবং গবেষণা।

জনাব তুষার চক্রবর্তী চাকরি সূত্রে বিভিন্ন সময় বিদেশে কিংবা দেশের বিভিন্ন বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় অবস্থান করার সুযোগ পেয়েছেন। চাকরি সূত্রে বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানের পাশাপাশি তিনি দুর্যোগ ও জলবায়ু বিষয়ক বিভিন্ন সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছেন। ফলে তিনি জেনেছেন বা বুঝতে পেরেছেন সৌরজগতে আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহটি ধীরে ধীরে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরাযন, শিল্পকারখানার বর্জ্য এবং কার্বন নিঃসরণ, বৃক্ষ নিধন, পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস সহ নানাবিধ কারণে জলবায়ু পরিবর্তন, হিমালয় এবং মেরু অঞ্চলের বরফ গলা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন আমাদের নিত্য সঙ্গী।

এই প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে মোকাবেলা করে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে প্রথম যে উদ্যোগটি গ্রহণ করা দরকার সেটি হলো দেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ ২৫ শতাংশে উন্নীত করা। তাহলেই আমরা নিজ দেশে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধির পাশাপাশি তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে আনতে সক্ষম হবো। মানুষের বাঁচার জন্য খাদ্যের পরেই প্রয়োজন অক্সিজেন। আর এই অক্সিজেনের ৭০ ভাগ যোগান আসে গাছপালা থেকে।

এই ভাবনা থেকেই জনাব তুষার চক্রবর্তী নিজ এলাকায় নিজের বাবার টাকায় এবং পড়ালেখার খরচ থেকে বাঁচিয়ে সেই টাকা তিনি বৃক্ষরোপণে খরচ করতেন। এতে তার বাবাই তাকে উৎসাহ যোগাতেন।

মূলতঃ বাবার উৎসাহেই তিনি দ্বিগুণ শক্তিতে কাজ করার সাহস পেতেন, বৃক্ষ প্রেমী হয়ে উঠার পেছনে বাবাই তার রিয়েল হিরু। এভাবে তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে গাছের চারা সংগ্রহ করে বৃক্ষরোপন করতেন এবং অন্যদের উৎসাহিত করতেন। তাঁর এমন কর্মকাণ্ডের ফলে নিজ এলাকায় তিনি বৃক্ষ প্রেমী হিসেবে পরিচিতি পান। বৃক্ষরোপণের মতো এই বিশাল কাজ করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। এই অর্থের সংস্থান করে গাছের চারা সংগ্রহের জন্য প্রতি মাসে নিজ বেতনের নির্দিষ্ট একটি অংশ তিনি রেখে দেন। যা এখনো চলমান। একজন চাকরিজীবি নিজ বেতনের নির্দিষ্ট একটি অংশ দিয়ে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বৃক্ষরোপণের মতো মহৎ কাজ করে যাচ্ছেন যা বিরল। বিভিন্নভাবে তিনি আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, এবং বন্ধু-বান্ধবদেরকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে বৃক্ষই জীবন, বৃক্ষ ছাড়া এই ধরা অচল, বৃক্ষ বিহীন আমাদের জীবন বিপন্ন। ফলে কেউ অর্থ দিয়ে, আবার কেউ গাছের চারা দিয়ে তাঁকে বৃক্ষ রোপনে সহায়তা করে আসছে।

এভাবে তিনি বৃক্ষ রোপনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে প্রতিঁষ্ঠা করেন “নবচেতনা মানবিক উন্নয়ন ফাউন্ডেশন” নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠনের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগণকে সহায়তার পাশাপাশি বৃক্ষ রোপন করে সবুজায়ন করে যাচ্ছেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে। এর মধ্যে তিনি যুক্ত হলেন দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৯৭ ব্যাচের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সৃষ্টি হলো তার হাজার হাজার বন্ধু, পরিচিত মহল কিংবা শুভানুধ্যায়ী । এদের মাধ্যমেও তিনি অর্থ কিংবা চারা সংগ্রহ করে আসছেন। তিনি যে এলাকায় চাকরি করেছেন সেখানেই বৃক্ষরোপনের মতো মহৎ কিন্তু দুরূহ কাজটি করেছেন। বৃক্ষ রোপনকে দুরূহ বলছি কারণ এই কাজটি করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন যার সংস্থান করা অত্যন্ত কঠিন। এই কঠিন কাজটিই তিনি করে চলেছেন নীরবে, নিভৃতে এবং নিঃস্বার্থভাবে। ৩০ লক্ষ বৃক্ষ রোপনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে তিনি দিনাজপুর, যশোর, খুলনা, সাতক্ষিরা, গাইবান্ধা, রংপুর, কক্সবাজারের চকরিয়া ও উখিয়া সহ দেশের নানা জায়গায় এই পর্যন্ত ৩২৮১৯ টি বিভিন্ন ফলজ, বনজ ও ফুলের চারা রোপন করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে আমলকি, জগডুমুর,আম, নারকেল, মাল্টা লেবু, পেয়ারা, বিলম্বি, অর্জুন, নিম, নাগলিঙ্গম, নাগচাপা,,তমাল, হিজল, জারুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, বকুল, সোনালো, কাঠগোলাপ, চন্দ্রপ্রভা, রাধাচূড়া, নিশিন্দা, কাঞ্চন, দেবদারু ইত্যাদি।

জনাব তুষারের মতো আমরাও এগিয়ে আসতে পারি নিজেদের প্রয়োজনে, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমরাই পারি নির্মল অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে, তৈরি করতে পারি পশুপাখির খাদ্য ও আবাসস্থল। এর মাধ্যমে আসতে পারে অর্থনৈতিক মুক্তি। সবুজ গড়ার লক্ষ্যে আমরাও হাত প্রসারিত করতে পারি। “একটি গাছ, একটি প্রাণ ” , এই স্লোগানকে ধারণ করে মাথা উঁচু করে বলতে পারি প্রিয় স্বদেশ সবুজায়নে আমিও অংশীদার।

  • লেখক: শিক্ষক আবদুল মালেক।

আরও খবর