নাসির উদ্দিন রকি, চট্টগ্রাম •
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে ট্রেন চলাচলের জন্য কাজ চলছে জোরেশোরে। ইতোমধ্যে ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে ৮২ কিলোমিটার দৃশ্যমান হয়েছে। শেষের পথে এই লাইনে নির্মাণাধীন ছোট-বড় ব্রিজ, কালভার্ট ও স্টেশন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষে হয়েছে ৮৬ শতাংশ।
গত ১৬ মে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন নির্মাণাধীন এই রেললাইন পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, সেপ্টেম্বরেই প্রকল্পের কাজ শেষ করে ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করতে চান। যদিও প্রকল্পের মেয়াদ আছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই রেললাইন চালু হলে কক্সবাজারে পর্যটন শিল্পের আরও প্রসার ঘটবে। পাশাপাশি কক্সবাজারে উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য লবণ, সবজি, মাছ ও রাবারের কাঁচামাল কম খরচে পরিবহন করা সম্ভব হবে।’
দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগেই অর্থাৎ সেপ্টেম্বরেই এ প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ করে ট্রেন চলাচলের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইতোমধ্যে ৮৬ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ শেষ করতে জোর চেষ্টা চলছে। ৮২ কিলোমিটার রেললাইন বসানোর কাজ শেষ। রেললাইনের ওপর থাকা ছোট-বড় ব্রিজ-কালভার্টের কাজও শেষ হয়েছে। এখন মেকানিক্যালের কাজ চলমান আছে। বর্তমানে যেভাবে কাজ এগোচ্ছে তাতে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আমরা শেষ করতে পারবো বলে আশাবাদী।’
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ১০০ কিলোমিটার রেলপথে কক্সবাজার আইকনিক স্টেশনসহ মোট স্টেশন থাকছে ৯টি। বাকি আট স্টেশন হলো সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ঈদগাঁও, রামু, কক্সবাজার সদর ও উখিয়া। এসব স্টেশনের কাজ শেষ হয়েছে। এ রেললাইনে সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি বড় রেল সেতু। এ ছাড়া নির্মাণ করা হচ্ছে ৪৩টি ছোট সেতু, ২০১টি কালভার্ট ও ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং। সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকায় তৈরি হচ্ছে একটি ফ্লাইওভার, রামু ও কক্সবাজার এলাকায় দুটি হাইওয়ে ক্রসিং। হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর চলাচলে ৫০ মিটারের একটি ওভারপাস ও তিনটি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হচ্ছে।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে নির্মাণ করা হচ্ছে ঝিনুক আকৃতির দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশন। যা দেশের একমাত্র আইকনিক রেল স্টেশন। কক্সবাজার ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর এই আইকনিক স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এ স্টেশনের নির্মাণকাজ প্রায় ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। স্টেশনটিকে সৈকতের ঝিনুকের আদলে তৈরি করা হচ্ছে। স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা ভবনটির বিভিন্ন অংশে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে।
নির্মাণাধীন আইকনিক ভবন ঘেঁষে ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থের তিনটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে। স্টেশনের পাশেই রেলওয়ের আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আটটি ভবনের নির্মাণকাজ চলমান আছে। স্টেশনটিতে আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যান্টিন, লকার, গাড়ি পার্কিং ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পর্যটকরা স্টেশনের লকারে লাগেজ রেখে সারা দিন সমুদ্রসৈকতে বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে পারবেন। এই স্টেশন দিয়ে দিনে ৪৬ হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করতে পারবেন।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, স্টেশনের কাজ পুরোপুরি শেষ করতে আরও ২-৩ মাস সময় লাগবে। এখন মেকানিক্যালের কাজ চলছে। পাশাপাশি শেষ সময়ের ফিনিশিং চলছে।
এদিকে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনে হুমকি হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ কালুরঘাট ব্রিজ। সেতুটি সংস্কার করে যাত্রীবাহী ট্রেন চালানো উপযোগী করতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই শুরু হবে কালুরঘাট সেতু মেরামতের কাজ। বর্তমানে এ সেতু দিয়ে ১২ মেট্রিক টন এক্সেল লোডের অর্থাৎ ছোট লোকোমোটিভ বা হালকা ওজনের কোচ চলাচল করে। তিন মাসের মধ্যে রেলওয়ে ব্রিজটি সংস্কার কাজ সম্পন্ন করে যানচলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন।
কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. কবির হোসেন বলেন, ‘কক্সবাজার রেল যোগাযোগের আওতায় এলে কৃষিপণ্য পরিবহনে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। কৃষকরা ন্যায্য দাম পাবেন। পাশাপাশি উৎপাদিত কৃষিপণ্য কম ভাড়ায় পরিবহনের সুযোগ পাবেন। জেলায় পান, সুপারির ব্যাপক ফলন হয়। চকরিয়ায় হয় সবজি। আছে লবণও। এসব পণ্য পরিবহন সহজ হবে।’
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরমধ্যে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার এবং রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের প্রায় সাত বছর পর ২০১৮ সালে ডুয়েল গেজ এবং সিঙ্গেল ট্র্যাক রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-