সাহাদাত হোসেন পরশ ও বকুল আহমেদ :
ক্রিস্টাল মেথ, কুশ, ম্যাজিক মাশরুম কিংবা শয়তানের নিঃশ্বাস– সবক’টিই সিনথেটিক ড্রাগ! ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইনের মতো প্রচলিত মাদককে পিছে ফেলে তরুণ প্রজন্ম এখন এসব নতুন নেশায় মেতেছে। মাদকের বাজারে সিনথেটিক ড্রাগ ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত লয়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রচলিত মাদকের চেয়ে সিনথেটিক ড্রাগ স্বাস্থ্যের জন্য কয়েক গুণ ক্ষতিকর। এসব মাদকের দামও বেশ চড়া। নানা কৌশলে অধিকাংশ মাদক সীমান্ত গলিয়ে ঢুকছে দেশে। আবার কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেও বিভিন্ন দেশ থেকে আসছে। সিনথেটিক ড্রাগ দেশে আনতে অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে ইনস্টাগ্রাম ও রেডিটে এমন কিছু পেজ পাওয়া গেছে, যা বৈশ্বিক মাদক কারবারিদের মধ্যে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে।
এদিকে অভিযান, গ্রেপ্তার ও কথিত বন্দুকযুদ্ধের মতো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলেও মাদক কারবারিরা আগের মতোই দাপুটে। অবৈধ পথে আসা ফেনসিডিল ও ইয়াবার ভয়ংকর জাল দীর্ঘদিনেও কাটা যায়নি। বেশ কিছু নতুন মাদক তালিকাভুক্ত না হওয়ায় প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না। মাদক নিয়ন্ত্রণের প্রচলিত যে পদ্ধতি, তাও খুব বেশি কার্যকর নয়। কোন সংস্থা কত সংখ্যক মাদক জব্দ করছে, কতজনকে গ্রেপ্তার করতে পারছে– ‘সাফল্য’ বলতে এই পরিসংখ্যান। মাদকের হাজার হাজার মামলা হলেও সাজার নজির খুব কম। ছিনতাই, চুরি, খুন, ইভ টিজিংয়ের মতো অপরাধের মূল কারণ ওই মাদক। এ পটভূমিতে আজ সোমবার নানা আয়োজনে পালিত হবে আন্তর্জাতিক মাদক প্রতিরোধ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য– ‘মানুষই মুখ্য। মাদককে না বলুন, শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।’
জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (ইউএনওডিসি) তথ্য বলছে, বাংলাদেশে যত মাদক ঢুকছে, এর মাত্র ১০ শতাংশ ধরা পড়ে। ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করেছিল র্যাব। এর পর আলাদাভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালায় পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।
ডিএনসির প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে নানা কৌশলে সিনথেটিক ড্রাগের চালান আসছে। ল্যাবে এসবের আলামত পাচ্ছি। স্কোপোলামিন নামে নতুন এক ধরনের মাদক এখন প্রায়ই ধরা পড়ছে। এটি ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ বা ডেভিলস ব্রেথ নামে পরিচিত। এটি ভয়ংকর হেলুসিনেটিক ড্রাগ। এটি মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। মানুষের চেতনা কেড়ে সর্বস্ব লুট করতে এটি ব্যবহার করে দুর্বৃত্তরা। একসময় এটি চিকিৎসাশাস্ত্রে রোগীকে অচেতন করার কাজে ব্যবহার করা হতো। এর ক্ষতির মাত্রা কোকেন থেকে বহু গুণ। ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’-এর নাম মাদক তালিকায় ওঠানোর কথা ভাবছে অধিদপ্তর।
‘শয়তানের নিঃশ্বাস’-এর প্রভাব এতটাই ভয়ংকর– নিঃশ্বাস, হ্যান্ডশেক, ঘ্রাণ, খাবার, চিরকুট, কোমল পানীয়, বাতাসে ফুঁর মাধ্যমে এই মাদক কারও শরীরে ঢুকতে পারে। এর পর মনের অজান্তে মানিব্যাগ, ঘড়ি, মোবাইল ফোন, মূল্যবান জিনিসপত্র এমনকি এটিএম কার্ডের পিন নম্বরও অন্যকে জানিয়ে দিতে পারেন ঘটনার শিকার ব্যক্তি।
আরেকটি সিনথেটিক মাদক হলো, সাইলোসাইবিন বা সাইকেডেলিক মাশরুম। তবে বিশ্বজুড়ে এর পরিচিতি ‘ম্যাজিক মাশরুম’ নামে। এটি খেলে প্রচণ্ড নেশা হয়; চারপাশের জগৎ রঙিন লাগে। আর মানুষের মস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে এক ধরনের প্রভাব ফেলে। এতে আচরণ, চিন্তাধারায় হঠাৎ পরিবর্তন দেখা দেয়। উদ্বেগের বিষয় হলো, দেশে এখন নেশার দুনিয়ায় নতুন নাম ‘ম্যাজিক মাশরুম’।
সম্প্রতি ক্রিস্টাল মেথ বা এলএসডির বাজারও বাংলাদেশে বড় হচ্ছে। প্রায়ই সীমান্ত এলাকা থেকে ক্রিস্টাল মেথের বড় বড় চালান জব্দ করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর জিগাতলায় একটি ছয়তলা বাড়ির নিচতলায় মাদক তৈরির কারখানার খোঁজ মেলে। সেখান থেকে ক্রিস্টাল মেথ জব্দ করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় হাসিব মুয়াম্মার রশিদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মালয়েশিয়ার নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সফটওয়্যার বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন তিনি।
মাদক বিশেষজ্ঞ ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান ড. অধ্যাপক ইমদাদুল হক সমকালকে বলেন, সিনথেটিক ড্রাগ তরুণ ও যুবসমাজের জন্য ঝুঁকির কারণ। এই ধরনের ঝুঁকি থেকে বের হওয়ার জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রমের ওপর আরও জোর দিতে হবে।
রাজধানীতে ১০০ কারবারি
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বারিধারা, বনানী, উত্তরা ও ধানমন্ডিতে আইস কেনাবেচা হয় বেশি। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১০০ কারবারি আইসের নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করছে।
তাদের অন্যতম রাসেল ওরফে ভাতিজা রাসেল ও তার স্ত্রী রুমানা, খবির, সারা, লাবণ্য, জসিম উদ্দিন, রিফাত রহমান ওরফে রোদেলা, চন্দন রায়, রামিসা সিমরান ওরফে ইডেন ডি সিলভা, জাবের খান, তারেক আহম্মেদ, প্রিয়াঙ্কা মতিন, রুবায়েত, মোহাইমিনুল ইসলাম ইভান, রবিন, হুন্ডা জামাল, জিয়া, রুমি, আলকী উকিল, সাগর, নাইম, ফাহান, নুসরাত, আলভী জাবরান তানহা, ফয়সাল, সিলেটি জালাল, পান মাসুদ, বাবর, থমাস, সৈয়দ আরিফুল ইসলাম, অপু, সুহৃদ, ল্যাংড়া জালাল, ফতেহ, ক্যাম্প কালু, হাবিবুর রহমান ওরফে টিপু হাবিব, সিরাতন, জনি, জান্নাত, মিলিসা, রাসেল রাজু, সুজা কেনি, সৈয়দা আনিকা জামান ওরফে অর্পিতা জামান, লায়লা আফরোজ প্রিয়া, শহীদুল ইসলাম খান, জহিরুল ইসলাম সুমন, নূরুল ইসলাম, মেজবাহ উদ্দিন ইমন, শিপন, মাসুম হান্নান, তানজিম আলী শাহ, হাসিবুল ইসলাম, ইফাজ সুলতানা, সামওয়া আকবর খান সায়েম, আল আমিন, আমিনুল ইসলাম, নাজমুল, ফিরোজ, খোকন, মাহির, সাইফুল, রাকিব বাসার, ঝাক্কি রুদ্র, মেহেদি জামিরুল, আরাফা আক্তার, সাইফুল্লাহ সুমন, খোশবার আলী, তৌফিক, আপেল ইসলাম, খালেদ ইকবাল, ফারুক ওরফে হাড্ডি ফারুক, তরঙ্গ জোসেফ কস্তা, মাসওয়া আকবর খান সায়েম, সোয়েব খান এবং মরিয়ম বেগম সুমি। তারা বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হয়েছে। এদের কেউ কেউ এখনও কারাগারে রয়েছে।
কী বলছেন ডিজি
ডিএনসির মহাপরিচালক (ডিজি) মো. আবদুল ওয়াহাব ভূঞা বলেন, আমাদের দেশে তো মাদক তৈরি হয় না। মাদক আসে অন্য দেশ থেকে। বিশেষ করে ইয়াবা ও আইস আসছে মিয়ানমার থেকে। দেশটির সঙ্গে পাঁচটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করা হয়েছে। মাদক বন্ধে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে তাদের কাছে। তারা সহযোগিতার হাত বাড়ালে মাদকের সীমান্তের রুট বন্ধ হবে।
তিনি আরও বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে আমরা বিভিন্ন নেটওয়ার্ক তৈরি করছি। ইতোমধ্যে ডিজিটাল পদ্ধতিতে গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমরা আশাবাদী, মাদক নিয়ন্ত্রণে আসবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ মাদকের সঙ্গে জড়িত। তাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দিলে মাদক নিয়ন্ত্রণ আরও সহজ হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-