আব্দুল কুদ্দুস, কক্সবাজার •
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর বলিবাজার থেকে পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে পালিয়ে আসেন মো. সালামত উল্লাহ।
মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের ডি-৫ ব্লকের একটি পাহাড়ের শেডে। বাঁশ ও ত্রিপলের ছাউনিযুক্ত ছোট্ট ঘরে ছয় বছরে জন্ম নিয়েছে তিন সন্তান। শরণার্থী হিসেবে সালামত উল্লাহর পরিবার বিনা মূল্যে চাল, ডাল তেল, জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পায়। কিন্তু মনে শান্তি নেই।
সালামত উল্লাহ (৫৩) বলেন, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় দিয়েছে। ছয় বছর ধরে বাংলাদেশ চেষ্টা চালাচ্ছে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের অনীহার কারণে এ পর্যন্ত একজনকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গারাও মিয়ানমারে ফিরতে রাজি। কিন্তু নাগরিকত্বসহ কয়েকটি দাবি পূরণ না হওয়ায় রোহিঙ্গারা ঠিকানাবিহীন জাতিতে পরিণত হচ্ছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে সালামত উল্লার মতো অন্তত আট লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্যের জন্মভিটা ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ।
এমন পরিস্থিতিতে আজ মঙ্গলবার (২০ জুন) বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসকে ঘিরে জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এবং কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতে নানা কর্মসূচি নিয়েছে। অবশ্য শরণার্থী দিবস নিয়ে রোহিঙ্গাদের কোনো কর্মসূচি নেই।
সর্বশেষ ৮ জুন উখিয়া ও টেকনাফের অন্তত ২০টি আশ্রয়শিবিরে হাজারো রোহিঙ্গা ‘গো-হোম’ ক্যাম্পেইন করেন। কর্মসূচির অংশ হিসেবে উখিয়ার লম্বাশিয়া ও কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে কয়েক হাজার রোহিঙ্গার পৃথক দুটি বড় সমাবেশ হয়েছে। অন্যান্য আশ্রয়শিবিরে মানববন্ধন, শোভাযাত্রা ও পথসভা করা হয়। সভা-সমাবেশগুলো থেকে রোহিঙ্গা নেতারা প্রত্যাবাসন শুরুর আগে চার দফা বাস্তবায়নের দাবি জানান। এগুলো হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নাগরিকত্ব দিতে হবে। রাখাইন রাজ্যে ফেলে আসা জন্মভিটাতে তাঁদের পুর্নবাসন করতে হবে। স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ এবং লুণ্ঠিত সম্পদ ও জায়গাজমি ফেরত দিতে হবে।
গত রোববার উখিয়ার বালুখালী, মধুরছড়া, লম্বাশিয়া এবং টেকনাফের শালবাগান, জাদিমুরা আশ্রয়শিবিরে শতাধিক রোহিঙ্গা নারী–পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের অধিকাংশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত দেন। তবে তাঁরা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নিয়ে ফিরতে চান। তাঁরা মনে করেন না মিয়ানমার সরকার এত সহজে তাঁদের নাগরিকত্ব দেবে। আবার নাগরিকত্ব না দিলে তাঁরা ফিরেও যাবেন না।
তাহলে এভাবে বাংলাদেশে কত দিন পড়ে থাকবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে টেকনাফের শালবাগান আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা নবী হোসেন (৫৫) দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘জানি না।’ কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, সর্বশেষ চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমারে পাইলট প্রকল্পের আওতায় এক হাজার পরিবারকে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, চলতি জুন মাসে প্রত্যাবাসন শুরু হবে। কিন্তু সম্প্রতি সেই প্রত্যাবাসন কার্যক্রমও থেমে গেছে।
লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা আবদুল মাজেদ (৫০) বলেন, সম্প্রতি মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল টেকনাফের শালবাগান আশ্রয়শিবিরে এসে প্রায় তিন শ রোহিঙ্গার সঙ্গে কয়েক ঘণ্টার বৈঠক করে। সেখানে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার পর কিছুদিন ট্রানজিট ক্যাম্পে রাখা হবে। তখন এনভিসি (ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড) প্রদান করা হবে। এরপর রাখাইনে তৈরি মডেল ভিলেজ প্রকল্পে পুর্নবাসনের পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। কিন্তু আস্থার সংকটের কারণে রোহিঙ্গারা যেতে রাজি হচ্ছে না। সংকট দূরীকরণে ইউএনএইচসিআর মধ্যস্থতা করতে পারে। কিন্তু পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রত্যাবাসন কার্যক্রমে ইউএনএইচসিআরকে রাখা হয়নি। সম্ভবত এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র পাইলট প্রকল্পের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলেছে বাংলাদেশকে।
কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা জালাল আহমদ (৫৫) বলেন, বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে প্রায় প্রতিদিন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি লেগেই আছে। মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মহড়া চালায়। তাতে সাধারণ রোহিঙ্গারা আতঙ্কে সময় পার করছেন। প্রত্যাবাসন শুরু হলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারত।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম থেমে নেই। সময়–সুযোগ হলেই পাইলট প্রকল্পের আওতায় টেকনাফের আশ্রয়শিবির থেকে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা হবে।
আরআরআরসি কাযালয় সূত্রমতে, চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে থেকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে ১ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাঁদের মধ্যে ৭১১ রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। অবশিষ্ট ৪২৯ রোহিঙ্গার বিষয়ে মিয়ানমারের অপত্তি ছিল। বাংলাদেশ সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল গত মার্চ মাসে টেকনাফে এসে ৪২৯ রোহিঙ্গার পাশাপাশি তাঁদের পরিবারে জন্ম নেওয়া আরও ৫১টি শিশুর তথ্য সংগ্রহ করে। রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জনের জন্য তাঁদের (রোহিঙ্গা) ২০ জনের প্রতিনিধিদলকে গত ৫ মে রাখাইনের পরিস্থিতি দেখানো হয়। গত ২৫ মে ১৪ সদস্যের মিয়ানমার প্রতিনিধিদল টেকনাফের শালবাগান আশ্রয়শিবিরে ২৮০ জন রোহিঙ্গা পরিবারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করে।
জাতিসংঘের মিয়ানমারের পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ের টম অ্যান্ড্রুস রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন
দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু করা দরকার বলে মনে করেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিটির সভাপতি ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হামিদুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের পরিবেশ–পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলছে। উখিয়ার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে খুনখারাবি বেড়েই চলেছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা ভারী অস্ত্র, গোলাবারুদ সংগ্রহ করছে। আশ্রয়শিবির এখন মাদক চোরাচালানের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আশ্রয়শিবিরগুলোতে প্রত্যাবাসনের পক্ষে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ঐক্যবদ্ধ করার মতো রোহিঙ্গা নেতারও অভাব রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-