ঋত্বিক নয়ন •
আর্থিক সচ্ছলতার আশায় লোভে পড়ে অনেকেই দুবাই গিয়ে নিজ পেশা ছেড়ে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ছেন। কিন্তু আড়ালেই থাকছে আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালান চক্র। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের ৩০টি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশে স্বর্ণের চালান আসে। এর মধ্যে ৭টি বিদেশি সিন্ডিকেট। দেশের ২৩টি সিন্ডিকেটের মধ্যে ১১টি সরাসরি আর ১২টি মানি এক্সচেঞ্জের আড়ালে। ১১টি দেশি সিন্ডিকেটের মধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরেই রয়েছে সাতটি। বাকি চারটির মধ্যে তিনটি চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর ও একটি রয়েছে সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর ঘিরে।
মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ধরা পড়া স্বর্ণ উদ্ধারে মূল কারণ যতটা না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কৃতিত্ব; তার চেয়েও বেশি সিন্ডিকেট সদস্যদের অন্তর্দ্বন্দ্ব। নিজেদের মধ্যে বনিবনা না হওয়া, উৎকোচ কমবেশি হওয়া, ভাগবাটোয়ারাতে কমবেশি হওয়া, সমঝোতার অভাব, তৃতীয় মাধ্যম হয়ে স্বর্ণ চোরাচালানের তথ্য ফাঁস হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গত তিন বছরে শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে অবৈধভাবে আনা ১৩৪ কেজি সোনা আটক করা হয়েছে। এসব পণ্যের বাজার মূল্য ৭০ কোটি টাকার বেশি। সর্বশেষ গত ৫ ও ৪ জুন পরপর দুইদিন দরজার কবজার মতো সাজিয়ে স্বর্ণ পাচারের অভিনব চেষ্টা ধরা পড়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, ৪ তারিখ জব্দকৃত স্বর্ণের মূল্য ৮৭ লাখ টাকা এবং পরদিন উদ্ধারকৃত স্বর্ণের মূল্য ৬৩ লাখ টাকা। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানের প্রসঙ্গে বিমানবন্দর কাস্টমসের সহকারী কমিশনার জয়নাল আবেদিন বলেন, আমরা যথেষ্ট সতর্ক আছি। আমাদের নিরাপত্তা বলয় বাড়ানোর কারণেই বড় চালানগুলি আমরা ধরতে সক্ষম হচ্ছি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতি মাসে বিভিন্ন বিমানবন্দরে ৫০ থেকে ৬০ কেজি স্বর্ণ আটক করা সম্ভব হলেও বিশাল অংশ থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদের অধিকাংশই স্বর্ণ চোরাকারবারি সিন্ডিকেট। ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে স্বর্ণ আনতে এই সিন্ডিকেট কয়েকটি ভাগে কাজ করে। দেশে আসার সময় প্রবাসী শ্রমিকরা ক্যারিয়ার গ্রুপ হিসেবে সিন্ডিকেটের কাছ থেকে নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে স্বর্ণ বহন করে। অথবা সিন্ডিকেট প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার তুলনামূলক বেশি দামে কিনে নিয়ে ওই দেশেই স্বর্ণের দেনা পরিশোধ করে এবং বাড়তি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে ব্যাগেজ রুলের আওতায় স্বর্ণ নিয়ে দেশে ফিরতে উৎসাহিত করছে।
বর্তমানে স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের প্রধান টার্গেট দুবাই থেকে আসা যাত্রীরা। এ কাজে উৎসাহিত করতে নানা প্রলোভন দেওয়া হয়। কখনো বিমান টিকিট, কখনো কমিশন, আবার কখনো বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্যের চেয়ে বাড়তি টাকা দেওয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, একটি সংঘবদ্ধ চক্র এ কাজে জড়িত। বিদেশে অভিবাসী কর্মীরা রেমিটেন্স পাঠানোর সময় এই চক্রের লোকজন তাদের মাধ্যমে দেশে স্বর্ণ পাঠায়। এই স্বর্ণ বিক্রির পর প্রবাসী কর্মীদের টাকা পরিশোধ করা হয়। এ কারণে আমরা যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রানুযায়ী চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর ব্যবহার করে যেসব স্বর্ণ পাচার হয় তার নেতৃত্ব দেয় হাসান ও আব্বাস। এ বিমানবন্দরে বিমানের সিট–টয়লেট, লাগেজ, চার্জার লাইট, জুতাসহ যাত্রীর পেটের ভেতরেও মিলছে স্বর্ণ। অভিযোগ আছে, বিমানসহ বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে কর্মরত কেবিন ক্রু এবং বিমানবন্দরের পরিচ্ছন্নতাকর্মী, মেকানিক, কাস্টমস, সিভিল এভিয়েশন ও ইমিগ্রেশন পুলিশের কতিপয় সদস্যের সহায়তায় চোরাকারবারিরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে এই রুটে অবৈধভাবে স্বর্ণ আনছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, স্বর্ণ চোরাচালান করে থাকে খুব শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এর সঙ্গে প্রভাবশালীরাও জড়িত। এ কারণে হোতাদের চেয়ে স্বর্ণ বহনকারীরাই আটক হচ্ছে বেশি। স্বর্ণ কার কাছ থেকে এসেছে, কোথায় যাবে বা কার কাছে যাবে, এসব বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানে না বাহকরা। ফলে তাদের আটকের পর কারা চোরাচালানের পেছনে রয়েছে তা শনাক্ত করা বেশ কঠিন। অনেক ক্ষেত্রেই তা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জানা গেছে, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রামের শাহআমানত বিমানবন্দর ও সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণ পাচার হচ্ছে। তবে এগুলো পাচার স্বর্ণ যাচ্ছে বর্ডার হয়ে ভারতে। সম্প্রতি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে আসা স্বর্ণগুলো ভারতে পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয় ভোমরা ও বেনাপোল স্থলবন্দর। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পর কাস্টমস, কাস্টমস গোয়েন্দা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চোরাকারবারীরা সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে স্বর্ণের চালানগুলো আকাশপথে দেশে প্রবেশ করায়। পরবর্তীতে অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের যোগসাজশে সেগুলো বাইরে নিয়ে আসা হয়। এরপর সেগুলো বেনাপোল ও ভোমরা সীমান্ত হয়ে ভারতে চলে যায়।
পিবিআইয়ের সিনিয়র এএসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তা একেএম মহিউদ্দিন সেলিম ওসি থাকা অবস্থায় স্বর্ণ চোরাচালানের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, স্বর্ণ চোরাকারবারিদের গ্রেপ্তারে আমরা অতীতের মতো বর্তমানেও কাজ করছি। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি ইউনিট এ নিয়ে কাজ করে।
সূত্র বলছে, চট্টগ্রামকে স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নেওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। এর অন্যতম কারণ প্রবাসী অধ্যুষিত চট্টগ্রামের অধিকাংশ মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকে। শ্রমিক শ্রেণির এসব মানুষকে সহজেই স্বর্ণ চোরাচালানের বাহক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া মহাসড়কে সব গাড়ি আলাদাভাবে চেকিংয়ের সুযোগ নেই, তাই প্রাইভেট গাড়িকে স্বর্ণ চোরাচালানে ব্যবহার করা হচ্ছে। আরেকটি সূত্র জানায়, গুটি কয়েক ধরা পড়লেও অনেক বড় বড় চালান আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে কাস্টমসের কর্মকর্তা, পুলিশ বিমানকর্মীসহ জড়িত থাকার কথা রয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা থানায় ওসি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকারী উৎপল কান্তি বড়ুয়া (বর্তমানে ঢাকা শেরেবাংলা থানার ওসি) বলেন, শাহ আমানত বিমান বন্দরে সোনা চোরা চালানের বেশির ভাগ মামলাই পতেঙ্গা থানায় হয়ে থাকে। মামলাগুলো তদন্ত করে সিআইডি। অনেক মামলা অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সৌদি আরবের স্বর্ণ চোরাচালানকারী সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে আছেন হাম্মাম আল হাবিব, রসুল আমিন জুব্বা, পিয়াস আল মারহাবি, রামাতুল ফারাজি, আনসার উল্লাহ জসিম। ভারতের সিন্ডিকেটে আছেন সুরেশ, আসিফ আহমেদ, অজিত, গোবিন্দ, বিজন হালদার, লক্ষ্মণ, গোপাল, কৃষ্ণ কুমার দাস, জুলহাস, রাতুল বাবু, কুমারজি, শ্যামল সাহা ও রামপাল। সিঙ্গাপুরের সিন্ডিকেটে আছেন সিন্ডিকেট এনডি ও স্টিফেন। পাকিস্তানি সিন্ডিকেটে আছেন আজমল হেলাল, মোহাম্মদ আলী, গিয়াস হাজারী, সোলায়মান, আব্দুর রহিম জিন্নাহ, আসিফ মোর্শেদী, রাজ্জাক ও হামজা। নেপালি সিন্ডিকেটে আছেন গৌরাঙ্গ রোসান। বিদেশে বাংলাদেশি সিন্ডিকেটে আছেন মতিয়ার রহমান খলিল, রেজাউল করিম, মোহাম্মদ আলী, মাসুদ করিম, মিন্টু, হামীম, সোনা রফিক, নাছির, গোল্ডেন মনির, নিজাম, রেজাউল, রবিউল, দেলোয়ার ও এমরান হোসেন।
স্বর্ণ চোরাচালানের ক্ষেত্রে রিয়াজুদ্দিন বাজার এক রহস্যময় এলাকার নাম। এখানে কোনো স্বর্ণের দোকান না থাকলেও গত দশ বছরে চট্টগ্রামে অবৈধ স্বর্ণ উদ্ধারের বিভিন্ন ঘটনায় ঘুরেফিরে রিয়াজুদ্দিন বাজারের নাম উঠে এসেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজার, তামাকুমন্ডি লেইন এলাকায় বিভিন্ন মার্কেটের উপর কক্ষ ভাড়া নিয়ে অবৈধ স্বর্ণের গুদাম বানিয়েছে আবু, হাকিম সাত্তারসহ অন্যান্যরা। যে দুটি কৌশল তারা সচরাচর ব্যবহার করে তার মধ্যে একটি হলো, তারা দশ জন যাত্রী নির্দিষ্ট করে, যাদের দেশে আসার প্লেন ভাড়া তারাই দিয়ে দেয়। তাদের কাজ থাকে সামান্য। তারা সামনের সিটের ব্যাক পকেটে প্যাকেটটা রেখে দেয়। দেশে আসার পর যে যার মতো চলে যায়। এরপর প্লেনে উঠে বিমানবন্দরের ক্লিনাররা। তাদের সুপারভাইজারের সঙ্গে চুক্তি থাকে। তারাই সেগুলো সংগ্রহ করে নামিনে নেয়।
দ্বিতীয় কৌশলটি হলো, একইভাবে নির্দিষ্ট যাত্রীদের বলা হয়, ওয়াশরুমের ডাস্টবঙে প্যাকেটটা ফেলে দিতে। তারা তাই করে। দেশে আসার পর ক্লিনাররা ডাস্টবঙের পলিথিন মুখ বন্ধ করে নিয়ে নেয় একটি বড় বাঙে। পরে তা নির্দিষ্ট এজেন্টের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। বেরুনোর পর এজেন্ট সিএনজি অটোরিঙায় সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত চলে আসে। সেখান থেকে উঠে যায় লোকাল বাসে। কিছুদূর পর নেমে উঠে টেম্পো বা সিএনজি টেঙিতে। আরো কিছুদূর যাওয়ার পর অপেক্ষারত মোটর সাইকেলে সোজা টান দিয়ে রিয়াজুদ্দিন বাজারে ঢুকে পড়ে। বিমানবন্দর দিয়ে আসা চোরাচালানের স্বর্ণ প্রথমে রিয়াজুদ্দিন বাজারের ভাড়া করা গুদামে জমা হয়। এরপর সেখান থেকে দেশের বাজারে যায় এবং বিদেশে পাচার হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামে স্বর্ণ পাচারে জড়িত একটি শক্তিশালী চক্র। তাদের কাছে বিভিন্ন দেশের একাধিক পাসপোর্টও রয়েছে। চোরাচালানে সহায়তা করেন দুবাই ও সিঙ্গাপুরের একটি মাফিয়া চক্র। নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজার, নিউমার্কেট, হাজারী গলি ও চকবাজারে চক্রটির একাধিক অফিস রয়েছে। চক্রের সদস্যরা হলো আবু, আলমগীর, আজম ওরফে হুন্ডি আজম, ইব্রাহিম, জাহিদ, নেজাম, জসিম প্রকাশ সিএনজি জসিম, আজগর, রহিম, ওসমান, আজম, ফয়েজ, পংকজ, শাহজাহান, সাত্তার, বিধান, কৃষ্ণ, মৃদুল, শচীন, জসিম, আতিক, আসিফ ও মামুন। চক্রটির সঙ্গে জড়িত রয়েছে আরও প্রায় ১৫ থেকে ২০টি উপ–সিন্ডিকেট। আর এ কাজে জড়িত ৪০ জনের একটি বাহক টিম।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-