কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ১১৫ কোটি টাকার ১২ তলা ভবন ফাঁকাই থাকছে

তোফাজ্জল হোসেন রুবেল,আজকের পত্রিকা •

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করার জন্য পর্যটন নগরীতে নির্মাণ করা হয়েছে ১২ তলার বিশাল ভবন। জনবল কম থাকায় ভবনের বড় অংশই থাকছে ফাঁকা
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করার জন্য পর্যটন নগরীতে নির্মাণ করা হয়েছে ১২ তলার বিশাল ভবন।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) ২৪০ জনের অনুমোদিত জনবলকাঠামোর মধ্যে কর্মরত আছেন ৩৫ জন। কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করার জন্য দেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্রে ১২ তলার এক বিশাল ভবন বানানো হয়েছে ১১৪ কোটি ৮৪ লাখ ৩১ হাজার টাকায়। গত বছরের ১৮ মে ভবনটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জনবল কম থাকায় ভবনের বড় অংশই ফাঁকা থাকছে। সেই অংশগুলো এখন বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দিতে শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ।

নথি থেকে জানা যায়, বর্তমানে একজন অথরাইজড অফিসার, একজন নগর-পরিকল্পনাবিদ, একজন সহকারী অথরাইজড অফিসার, একজন সহকারী নগর-পরিকল্পনাবিদ, তিনজন ইমারত পরিদর্শক, একজন কানুনগো, একজন সার্ভেয়ারসহ ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, আরও কিছু নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন।

গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব কাজী ওয়াসি উদ্দিন বলেন, ‘এখন লোকজন কম; তবে নিয়োগ-প্রক্রিয়া চলছে। আর যে জায়গাটুকু ফাঁকা আছে, তা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে কিছু আয় বাড়ানোর জন্য।’

বিশাল ভবনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন
কক্সবাজার পৌরসভার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কউকের অনুমোদিত জনবলকাঠামোর সব লোকও যদি থাকে তাহলে তিনতলার বেশি ভবনের প্রয়োজন হবে না। সেখানে সোয়া শ কোটি টাকা খরচ করল কোন যুক্তিতে? এখন ১২ তলা ভবন পরিষ্কার রাখতে এবং বিদ্যুৎ বিলসহ নানা সার্ভিস দিতে হিমশিম খাবে। বাধ্য হয়ে সরকারি ভবন ভাড়া দিয়ে আয়-রোজগারের পথ খুঁজে নিয়েছে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচতলা ভবনই যথেষ্ট। সেখানে ১২ তলা করল! এখন বিদ্যুৎসহ অন্যান্য ইউটিলিটি সার্ভিস ব্যবহারেও অপচয় হচ্ছে। এত বড় স্থাপনা করে একটি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ভাড়া দিচ্ছে। তারা তো জানে কতজনের জন্য এ ভবন। এখন ভাড়া দেওয়ার আগে যারা এটি নির্মাণ করেছে, তাদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া উচিত।’

জানা যায়, এনআরবি ব্যাংক, এডিবি, ইউএনডিপিসহ কিছু প্রতিষ্ঠান স্পেস ভাড়া নিয়েছে ভবনটিতে। এর আগে সাফরান নামের একটি রেস্টুরেন্টের জন্যও ভাড়া দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে কউক চেয়ারম্যান কমোডর (অব.) মোহাম্মদ নূরুল আবছার বলেন, ‘আমাদের এখন যে জনবল আছে, তাদের জন্য পুরো জায়গা লাগছে না। কিছু স্পেস ভাড়া দিচ্ছি। সেখান থেকে যে আয় হবে তা দিয়ে আউটসোর্সিংয়ের লোকজনকে বেতন-ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করব।’

মহাপরিকল্পনা হয়নি
২০১৬ সালে কউক প্রতিষ্ঠার আইন পাস হয়েছে। সাত বছর পরও সংস্থাটি পর্যটন শহর ঘিরে কোনো মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারেনি। মহাপরিকল্পনার জন্য কয়েক দফা কাটছাঁট করে ১৭৪ কোটি ৭২ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে কউক। এটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের মার্চ।

এ বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব কাজী ওয়াসি উদ্দিন বলেন, ‘তাদের এখন কাজ কিছুটা কম; তবে কিছু কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। আর মহাপরিকল্পনার প্রকল্পও প্রাথমিকভাবে অনুমোদিত হয়েছে।’

বড় অবৈধ স্থাপনায় হাত পড়েনি
জানা গেছে, মহাপরিকল্পনা না হলেও তড়িঘড়ি করে সমুদ্রসৈকতের পাড় ঘেঁষে স্থাপনা নির্মাণ করে যাচ্ছে একটি মহল। ইমারত নির্মাণ আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কমপক্ষে ১০টি বড় আকারের হোটেল নির্মাণকাজও চলছে। জনবলসংকট আর সঠিক কর্মপরিকল্পনার অভাবে আশানুরূপ কার্যক্রম নেই কউকের। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো উচ্ছেদ কার্যক্রম চালালেও বড় আকারের অবৈধ স্থাপনায় হাত দেয়নি। এ বিষয়ে কউক চেয়ারম্যান বলেন, উচ্ছেদ চলছে, বড় স্থাপনায় হাত দেওয়া যাচ্ছে না।

রাস্তা-ফুটপাত নির্মাণেও কউক
জানা যায়, ২৫৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের আওতায় হলিডে মোড় থেকে বাজারঘাটা-পালপাড়া (বাস টার্মিনাল) পর্যন্ত রাস্তা ও ফুটপাত নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে সৌন্দর্যবর্ধনের সঙ্গে নালাও নির্মাণ করা হয়েছে। প্রধান সড়ক থেকে অস্বাভাবিক উঁচু ফুটপাত বানানোয় কিছুটা ক্ষোভ রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। বিষয়টি নজরে আসার পর কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিবের কাছে চিঠিও দিয়েছেন।

আবাসন প্রকল্পেই আগ্রহ বেশি
পরিকল্পিত পর্যটন শহর গড়তে উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি ও তদারকি প্রধান দায়িত্ব হলেও কউক হাত দিয়েছে আবাসন ব্যবসায়। এরই মধ্যে সদর উপজেলায় ‘কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আবাসিক ফ্ল্যাট উন্নয়ন প্রকল্প-১’ শীর্ষক এ প্রকল্পে প্রথম ধাপে ফ্ল্যাট বিক্রি শেষ করেছে সংস্থাটি। জালংজা মৌজায় চারটি ১৫ তলা ভবনে মোট ৩৪৯টি ফ্ল্যাট বানিয়ে বরাদ্দ দিয়েছে। প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের মূল্য ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮৯৫ টাকা। প্রকল্পটি ঘিরে কউকের বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার অভিযোগও ছিল সরকারি সংস্থার।

সার্বিক বিষয়ে অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে লক্ষ করছি, কিছু সংস্থা নিজেদের ইচ্ছেমতো ইমারত নির্মাণের প্রকল্প নিচ্ছে। তা বাস্তবায়ন করার পর দেখা গেছে, বেশির ভাগই ব্যবহৃত হচ্ছে না।

আরও খবর