লোকমান হাকিম •
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার চারপাশে কয়েক বছরের ব্যবধানে গড়ে উঠেছে বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ বন। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলের মানুষকে রক্ষাকারী এসব বন প্রতিনিয়ত সাবাড় হচ্ছে। সেখানে বন কেটে চিংড়ি ঘের নির্মাণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় প্রভাবশালীরা নেতারা।
বিশেষ করে, হোয়ানকের অমাবশ্যাখালী মৌজার ম্যানগ্রোভ বন পরিণত হয়েছে বিরাণভূমিতে।
দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযানের সমন্বয় না থাকায় দখলবাজদের তৎপরতা বেড়েই চলেছে। থানা পুলিশ কিংবা উপজেলা প্রশাসনসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা অভিযানে সমর্থন দিলেও ঘটনাস্থলে যেতে চায় না, এমন অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রামের উপকূলীয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবাই সমর্থন দেয়, কিন্তু সরেজমিনে অভিযানে কেউ অংশ নেয় না। এ জন্য অনেক সময় আমরাও ঝুঁকিতে থাকি।’
বন বিভাগের তথ্য বলছে, দখলদারদের বিরুদ্ধে দু’দফা অভিযান পরিচালনা করে ঘেরের বাঁধ কেটে দেয়া হয়। থানা ও বন আদালতে দায়ের করা হয়েছিল ১৯টি মামলা। এর মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়েরকৃত মামলায় ২২ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ধরা হয়েছে। দখলকৃত ভূমির পরিমাণ ৩০০ একর। নিধন করা হয়েছে ১২ হাজার বাইন গাছ।
উপজেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, শাপলাপুর, কুতুবজোমের সোনাদিয়া ও ঘটিভাঙ্গা, ধলঘাটার হাঁসেরচর, হোয়ানকের আমাবশ্যাখালী ও মাতারবাড়ির চারপাশে ২৫ হাজার একর চর জেগে উঠে। এসব চরে ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বন বিভাগের পক্ষ থেকে প্যারাবন সৃজন করা হয়।
পরিবাদী সংগঠনগুলো বলছে, ম্যানগ্রোভ বন প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলের লাখ লাখ মানুষের জানমাল ও কোটি কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ রক্ষা করে। মহেশখালীর মতো ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলে ম্যানগ্রোভ বনকে চিংড়ি ঘেরে পরিণত করে স্বার্থান্বেষী দখলদাররা সেই ঝুঁকি প্রতিনিয়ত আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক এইচএম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শ আলাদা হলেও দখলদারিত্বে তারা ঐক্যবদ্ধ। বিষয়টি দুঃখজনক ও নিন্দনীয়।’
অমাবশ্যাখালী বিরাণভূমি :
গত ২২ মে বেলা ১২টা। হোয়ানক ইউনিয়নের কালাগাজিরপাড়া বাজারের পশ্চিম পাশের কাঁচা রাস্তা ধরে গন্তব্য অমাবশ্যাখালীর বগাচতর চিংড়ি ঘের। সবুজ গাছগাছালিতে ভরপুর এ এলাকার লোকালয় পেরিয়ে সামনে পড়ে জামিরার খালের ত্রিমখুী মোহনা। শাখা খাল দুটি মিশেছে বঙ্গোপসাগরে।
জ্যৈষ্ঠের খরতাপ উপেক্ষা করে ডিঙি নৌকায় চেপে পশ্চিমে পার হতে দেখা মিলল মোহাম্মদ হোসেন নামের এক লবণ চাষীর। তাঁর সাথে আলাপের একপর্যায়ে তিনি জানালেন, ‘প্রথমে কেরোসিন ঢালা হয়, তারপর লাগানো হয় আগুন। একে একে করাত দিয়ে কেটেছে সব গাছ।’ কারা কেটেছে এমন প্রশ্নে বলে উঠলেন, নাজু, মতিন, এরশাদ। তারা জমিদার, তাদের দখলেই খাল-বন।’
মো. হোসেনের কথার সত্যতা মেলে বগাচতর চিংড়ি ঘেরের পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে। সেখানকার এক সময়ের সবুজ ম্যানগ্রোভ বন এখন বিরাণভূমি। বাইন গাছগুলোর শ্বাসমূল ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। কোনো কোনো শ্বাসমূলে সবুজ পাতা গজিয়েছে। প্রশাসনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের স্কেভেটর দিয়ে বাঁধ তৈরীর দৃশ্য চোখে পড়ে।
দখলে অভিযুক্ত যারা:
স্থানীয় প্রশাসন ও বনবিভাগের মামলার নথি অনুযায়ী, প্রথমদিকে মহেশখালীর প্যারাবন দখলবাজিতে নেতৃত্ব দেন জাতীয় পার্টির নেতা শাহাবুদ্দিন। তবে দ্বিতীয় দফায় নেতৃত্বে দেন হোয়ানক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ ওয়াহিদ শামীম, ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি আবদুল মতিন এবং এরশাদুল ইসলাম। এছাড়া আরও রয়েছেন হোয়ানক ইউনিয়ন বিএনপির নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান এনামুল করিম চৌধুরী।
তাঁদের নেতৃত্বে হোয়ানকের মোহাম্মদ সিকদার, আবদুস ছালাম, সুলতান মাহমুদ কলি, মোহাম্মদ আমিন, শাহাদাত কবির শাহাদাত, নাজেম উদ্দীন নাজু, ছদর আমিন, ইসহাক, পেঠান আলী, আব্দুল জব্বার, আব্দুল্লাহ আল মামুন, আবদুল করিম, আমির হোসেন, আকতার হামিদ, মারুফুল হক, সাইফুল ইসলাম, মকসুদ, জাকির হোসেন, মোহাম্মদ আলম, তারেকুল ইসলাম, আহসান উল্লাহ, মোহাম্মদ বেলাল, খুলু মিয়া, আনছার উল্লাহ, জসিম উদ্দিন, কফিল উদ্দিন, ইমরুল কায়েস মানিক, মনু মিয়া, মুজিবুল হক, জিয়াবুল হক, এরশাদ, তৌহিদুল ইসলাম, রুহুল কাদের বাদশা, শহিদুল ইসলাম সোহেল, এমদাদুল ইসলাম রাসেল, রুবেল, মোস্তাক আহমদ, রফিক উদ্দিন, শাহ নেওয়াজ রুবেল, আতাহার উদ্দিন, মোস্তফা কালাম বকুল, রমিজ উদ্দিন বাদশা, ওবাইদুল হোসেন, হাজী আব্দুস শুক্কুর ও রহমত আলী। তাঁরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে ফিরোজ ওয়াহিদ শামীম, শাহাব উদ্দিন ও এরশাদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা বিষয়টি বিষয়টি এড়িয়ে যান। এ ব্যাপারে কেউই কথা বলতে রাজি হননি।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের উপকূলীয় রেঞ্জের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুর রহমান বলেন, ‘এরশাদ, শাহাবুদ্দিন ও মোহাম্মদ সিকদার নামে তিনজন ভূমিদস্যু দখলদারিত্বের নেতৃত্ব থাকলেও তাঁদের পেছনে স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা জড়িত। আমরা দু’দফা অভিযান চালিয়ে তিনটি ঘেরের বাঁধ কেটে দিয়েছিলাম। নতুন করে দখল হলে পুণরায় অভিযান পরিচালনা করা হবে।’
আবদুর রহমান আরও বলেন, ‘একে তো জায়গাটা দুর্গম, তার উপর স্কেভেটর পরিবহনের জন্য ওয়াটার বাসের ব্যবস্থাও নেই। স্থানীয়ভাবে কক্সবাজারে ভাড়ায় চালিত স্কেভেটর না থাকায় চট্টগ্রাম থেকে আনতে হয়। যার কারণে খরচ অনেক বেশি। তাছাড়া বিচ্ছিন্ন দুর্গম এলাকায় শ্রমিক নিয়ে অভিযানের প্রয়োজনীয় বরাদ্দও সময় মতো পাওয়া যায় না।’
বন বিভাগের নথি অনুয়ায়ী, হোয়ানক ইউনিয়নের অমাবশ্যাখালী মৌজার পশ্চিমে ৩০০ একর ম্যানগ্রোভ বনের ১২ হাজার গাছ কেটে তিনটি ঘের নির্মাণের ঘটনায় মহেশখালী উপকূলীয় রেঞ্জের ঝাপুয়ার বিট কর্মকর্তা এইচএম মাহমুদুল হাসান বাদি হয়ে থানায় তিনটি মামলা করেন। এছাড়া বন আদালতে আরো ১৬টি মামলা দায়ের করে বন বিভাগ। তবে এসব মামলায় কোনো আসামি গ্রেফতার হননি। এরই মধ্যে অনেকে আদালত থেকে জামিনে মুক্ত।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, ‘ম্যানগ্রোভ বন শুধু ঘূর্ণিঝড় থেকে মানুষকে বাঁচায় না, ভাঙন থেকেও রক্ষা করে। বননিধন ঠেকাতের সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন জরুরি।’
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-