সুজাউদ্দিন রুবেল •
- সাগরে কে জেলে, কে দস্যু চেনা মুশকিল! মাছ ধরতে গিয়ে গুম, খুন, লুট, অপহরণসহ দস্যুদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন জেলেরা। এক কথায় বলা যায়, যেন অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলসীমা।
প্রশাসনের দায়হীনভাবের কারণে উপকূলে দস্যুদের অত্যাচার, নির্যাতন সবকিছু আড়াল থেকে যায়। তাইতো অভিযোগের পাশাপাশি ট্রলার মালিক ও জেলেদের দাবি, তাদের সুরক্ষায় বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা জোরদারের।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, এ জেলায় নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ৫ হাজার ১১৩টি; নিবন্ধিত জেলে ৬৪ হাজারের মতো। এর বাইরে আর কোনো নৌযান নেই। আর জেলে থাকলেও কয়েকজন থাকতে পারে। কিন্তু প্রতিবছরই তালিকা আপডেট হয়।
বাঁকখালী নদীতে নোঙর করা ট্রলার খাজা আজমির-এ অবস্থান করছেন জেলে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। দীর্ঘ ১৭ বছরের জেলে জীবনে চার বারের বেশি সাগরে দস্যুদের হামলায় শিকার হয়েছেন। কিন্তু সাগরে দস্যুদের অস্ত্রের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ ও ভয়ের কারণ বর্ণনা করেন তিনি।
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে সবচেয়ে ডাকাতি করছে বাঁশখালী, কক্সবাজারের মহেশখালী, সোনাদিয়া ও কুতুবদিয়ার দস্যুরা। কিছুদিন আগেও মাছ নিয়ে কক্সবাজার উপকূলে ঢুকতে ছোট ট্রলার নিয়ে দস্যুরা ধাওয়া করেছে। আমরা দস্যুদের অস্ত্রের কাছে কিছু না। এসব বিষয় বোট মালিক সমিতিকে জানালোও কিছু হয় না। কারণ ট্রলার মালিকরা ঐক্যবদ্ধ নন। তারা আমাদের জীবন নিয়ে চিন্তাও করেন না।’
শুধু জাহাঙ্গীর নন, একই অবস্থা কক্সবাজার উপকূলের অন্যান্য জেলেরও। জীবিকার তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে চলে তাদের সাগরে মৎস্য আহরণ। এতে কেউ প্রাণ হারান, কেউ বা ভাগ্যের জোরে ফিরে আসেন। কিন্তু সাগরে গিয়ে জীবন বাঁচাতে দস্যুদের কাছে কীভাবে অসহায় হয়ে পড়েন তারও বর্ণনা দেন জেলেরা।
মহেশখালীর মোক্তার আহমদের মালিকানাধীন এফবি আল্লাহ দান ট্রলারের জেলে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সাগরে গিয়ে মাছ শিকার করি। এখানে মাছ শিকারের সময় দেখি সব ট্রলারেই জাল আছে। দস্যুদের ট্রলার চেনার কোনো উপায়ও নেই। দস্যু যারা আছে, তারা হঠাৎ করে সন্ধ্যা বা রাতে আক্রমণ করে বসে; কোনোভাবেই বোঝার কোন উপায় থাকে না।’
এ দিকে জেলেদের পাশাপাশি দস্যুদের কাছে জিম্মি ট্রলার মালিকরাও। ট্রলারের সবকিছু হারিয়েও উপকূলে দস্যু সিন্ডিকেটের ভয়ে যান না প্রশাসনের কাছে। আবার মোহাম্মদ আবু নামে এক ট্রলার মালিকের অভিযোগ, সব হারিয়ে কেউ কেউ প্রশাসনের কাছে গিয়েও কোন সহযোগিতা পাননি।
তিনি বলেন, ‘সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে আমার ট্রলারে জলদস্যুরা হানা দিয়ে ২২টি জাল নিয়ে যায় এবং মাঝিমাল্লাদের মারধর করে। এরপর ইঞ্জিনটি বিকল করে দিয়ে জলদস্যুরা চলে যায়। তারপরও আমরা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করি না; কারণ জলদুস্যদের অনেক সিন্ডিকেট উপকূলে রয়েছে, যারা দস্যুদের মাছ ও জাল বিক্রি করে। ওই সিন্ডিকেট প্রশাসনকে আমরা যে অভিযোগ করেছি, সেসব তথ্য দ্রুত দিয়ে দেবে। ফের আমার ট্রলার সাগরে মাছ শিকারে গেলে অপহরণ, হত্যা কিংবা মারধর করবে – এ ভয়ে প্রশাসনকে কিছুই জানাইনি।’
আবু আরও বলেন, প্রশাসন যদি এগুলো নিয়ে তদন্ত করে, তবে অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে। জলদস্যুদের মাছ কারা বিক্রি করে, ডাকাতির মালামাল কারা সামাল দেয় – সবকিছু বেরিয়ে আসবে।
ফিশারিঘাটস্থ আড়তদার সমিতির সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ আজাদ বলেন, দস্যুদের নিরাপদ স্থান সাগর। কারণ দস্যুরা যখন সাগরে দস্যুতা করে, তখন জেলেরা বিষয়টি প্রশাসনকে অবহিত করেন। কিন্তু পুলিশ কিংবা কোস্টগার্ড সাগরে ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগেই দস্যুরা লুটপাট চালিয়ে চলে যান। আর সাগরে যেখানে মাছ বেশি ধরা পড়ে সেখানে জলদস্যুদের দৌরাত্ম বেশি থাকে।
আরেক ট্রলার মালিক শফি উল্লাহ বলেন, ‘সাগরে মাছ শিকারের সময় জলদস্যুরা ট্রলার ও মাঝিমাল্লাদের নিয়ে গেছে। এরপর মোবাইলে মুক্তিপণ দাবি করে। এসব বিষয় প্রশাসনকে জানালে পাত্তা দেয় না তারা। কারণ সাগরে ঘটনা ঘটেছে। তারা একবার বলে সোনাদিয়ায় যাও, আবার বলে মহেশখালী যাও, নয়তো পাতুয়ারটেক কিংবা উখিয়া যাও। এভাবে সময় চলে যায়; কিন্তু কোনো সুরাহা পায় না।’
এ বিষয়ে কক্সবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, ‘সাগরে মৎস্য সম্পদের ভান্ডারে স্বভাব বশে হোক অথবা যেকোনো ভাবেই হোক, বিচ্ছিন্ন কিছু জলদস্যুতার বিষয় আমাদের কানে আসে। সে বিষয়গুলো আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করবে। সেখানে পুলিশ, নৌ-পুলিশ, র্যাব, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে।’
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি; কিন্তু গভীর সাগরে তো! কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে গিয়ে টহল দেয়া যায় না। তারপরও যারা জলদস্যুতার সঙ্গে জড়িত বা সাগরে যারা অপরাধ করে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করছি।’
জেলা ফিশিং বোট মালিক জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে কক্সবাজার উপকূলে ২০০১ সালে হিমঘরে বন্দি করে হত্যা করা হয়েছিল ১৪ জেলেকে। এরপর ২০০৯ ও ২০১০ সালে কক্সবাজারের খুরুশকুলের ১৭ জেলে ও পেকুয়ার ১৪ জেলের মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল। তারপর ২০১৩ সালে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তিনটি ট্রলারের ৩৪ জেলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আর গত ২৩ এপ্রিল ট্রলারের হিমঘর থেকে উদ্ধার হয় ১০ জনের মরদেহ।
এর বাইরে গত ৫ বছরের সাগরে কক্সবাজারের কমপক্ষে ২০ জেলেকে হত্যা করা হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন শত শত; লুট হয়েছে কয়েক হাজার ট্রলার।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-