বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের প্রায় ছয় বছরের মাথায় মিয়ানমার এই প্রথমবারের মতো তাদের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি প্রতিনিধিদলকে রাখাইনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
রাখাইন পরিস্থিতি প্রত্যাবাসনের জন্য কতটা অনুকূল তা দেখতে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ২০ সদস্যের একটি রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের আগামী শুক্রবার রাখাইনের মংডুতে যাওয়ার কথা রয়েছে। এ মাসে প্রথম ধাপে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিনিধিদলটি রাখাইনে যাবে। কূটনৈতিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত ১৮ এপ্রিল কুনমিংয়ে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছিল। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, চলতি মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর পরিবেশ কতটা অনুকূল তা দেখতে তাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা আগামী শুক্রবার রাখাইনে যাবেন। ওই সফরের এক সপ্তাহের মধ্যে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজারে এসে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবে। সব ঠিকঠাক এগোলে চলতি মাসে ১ হাজার ১৭৬ জন রোহিঙ্গার প্রথম দলটি নিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় চীন ও মিয়ানমার।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের পর প্রায় ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও দুই দফা তারিখ চূড়ান্ত করে প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। বিশেষ করে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ এবং মিয়ানমারের সদিচ্ছার অভাবের কারণে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে রাজি করানো যায়নি।
- মিয়ানমার এ মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি ছলচাতুরী হতে পারে কি না, সেটি বিবেচনায় নিয়ে সতর্কভাবে এগোনোই সংগত হবে।
মো. শহীদুল হক, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব
এমন একটা সময়ে মিয়ানমার হঠাৎ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চাইছে, যখন আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) দেশটির বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলায় পাল্টা যুক্তি উপস্থাপনের সময়সীমা নির্ধারণ করা আছে। ২৪ মে আইসিজেতে মিয়ানমারের বক্তব্য উপস্থাপনের কথা রয়েছে।
এ ছাড়া আগামী জুনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে পাশ্চাত্যের দেশগুলোকে নিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি নতুন প্রস্তাব উত্থাপনের প্রস্তুতি চলছে। ফলে চীনকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সব৴শেষ এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর একটি পদক্ষেপ হিসেবে মনে করেছেন আন্তর্জাতিক–সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে চীন কয়েক মাস ধরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের বিশেষ দূত দেং সি জুন মিয়ানমার সফর করেন। গত মাসের শুরুতে তিনি ঢাকা সফর করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবং পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দেখা করেন।
লক্ষণীয় বিষয় হলো—অতীতে চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ এ ধরনের সফর নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বললেও এবার ঘটনা ঘটেছে উল্টোটা। কারণ, ডিসেম্বরে চীনের বিশেষ দূতের মিয়ানমার এবং এপ্রিলে ঢাকার সফরগুলো হয়েছে অনেকটা নীরবে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশ দুই দেশই চীনা দূতের সফরের বিষয়টি গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলেছে।
তবে চীনের বিশেষ দূতের সফরের পর শিগগিরই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়া পর্যন্ত বলা যায় না। কারণ, এর আগে দুই বার তারিখ দেওয়ার পরও তা ভেস্তে গেছে। তবে আমরা আশা করি, তাঁরা দ্রুত ফিরে যাবেন।’
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের রাখাইনে ঘুরিয়ে দেখানোর বিষয়টি আলোচনায় এলেও মিয়ানমার তাতে রাজি হয়নি। এবার হঠাৎ করেই রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের রাখাইনে নিতে রাজি হয়েছে। এ মাস থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের যে আগ্রহ চীন ও মিয়ানমার দেখাচ্ছে, তা কতটা বাস্তবসম্মত সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ, প্রত্যাবাসন শুরুর আলোচনা এগোলেও বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মৌলিক কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেছে।
মতপার্থক্য থেকে গেছে
চীনের মধ্যস্থতায় গত মাসে কুনমিংয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হলেও বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন আলাদা আলোচনায় বসেছিল। পরে তিন দেশ একসঙ্গে আলোচনায় বসে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এ বছর আরও ৫ ধাপে প্রতিবারে ১ হাজার ২০০ জন করে ৬ হাজার রোহিঙ্গাকে ডিসেম্বরের মধ্যে রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। ওই বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা পর্যালোচনার জন্য আগামী ডিসেম্বরে পরবর্তী বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
তবে কুনমিংয়ের বৈঠকে ১ হাজার ১৭৬ রোহিঙ্গাকে ফেরানোর পাশাপাশি আরও ৬ হাজার রোহিঙ্গাকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও মৌলিক কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের মতপার্থক্য দূর হয়নি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সই হওয়া প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী প্রতিদিন ৩০০ জন করে সপ্তাহের ৫ দিনে ১ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গাকে পাঠানোর কথা। কিন্তু মিয়ানমার এখন বলছে, তাদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি থাকায় প্রতিদিন ৩০ জন করে সপ্তাহের ৫ দিনে ১ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে। আর বাংলাদেশ বলছে, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা ঢলের মাত্র তিন মাসের মাথায় অনেকটা চীনের চাপে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছিল। ওই সময় একাধিকবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করেছিলেন চীনের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। নেপথ্যে চীন থাকলেও তখন বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয়ভাবে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সমঝোতা স্মারক সইয়ের সময় ওয়াং ই নেপিডোতে অবস্থান করছিলেন।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের জ্যেষ্ঠ ফেলো মো. শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ সব সময় প্রত্যাবাসনকে রোহিঙ্গা–সংকটের একমাত্র সমাধান বিবেচনায় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এ সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ যে আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছে, সেটি মিয়ানমারের কখনোই ছিল না। বিভিন্ন সময় নিরাপত্তা পরিষদ, আইসিজেসহ আন্তর্জাতিক নানা ফোরাম থেকে মনোযোগ সরাতে মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের বিষয়টি সামনে এনেছে। অতীতের ধারাবাহিকতায় মিয়ানমারের সদিচ্ছা আছে কি না, সেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ফলে মিয়ানমার এ মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর যে প্রস্তাবটি দিয়েছে, সেটি ছলচাতুরী হতে পারে কি না, সেটিও বিবেচনায় নিয়ে সতর্কভাবে এগোনোই সংগত হবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-