সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দারাঃ ‘করোনারে চিনি না, শুনতেছি দেশে আইছে’

সুজাউদ্দিন রুবেল, সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে :
‘আমরা দ্বীপ এলাকার মানুষ। করোনারে চিনিও না, জানিও না। শুনতেছি বিদেশ থেকে দেশে আসছে। মাইকিং করতেছে শুনতেছি। এখন জানতে চাই, এটার জন্য কিভাবে চলাফেরা করতে হবে।’ করোনা ভাইরাস সম্পর্কে এভাবে অভিমত ব্যক্ত করছিলেন সেন্টমার্টিন দ্বীপের ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ আব্দু সামাদ।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের জেটিঘাটে বসে আছে ৬০ বছর বয়সী রফিক আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা অশিক্ষিত মানুষ। দিনে এনে দিনে খায়। কোন রকম সংসার চলে। এখন ভাইরাস আসলে কি হবে? আগে তো আমাদের পেটে ভাত দিতে হবে। তারজন্য কাজ করতে হবে। কাজ না করলে খাবো কি?
দেশের সর্বদক্ষিণের দ্বীপ সেন্টমার্টিনে বসবাস করে ১০ হাজারের বেশি মানুষ। যাদের মধ্যে অধিকাংশই অশিক্ষিত ও হতদরিদ্র। বিশ্বে মহামারি এখন করোনা ভাইরাস। কিন্তু এ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই দ্বীপের বাসিন্দাদের।

সরজমিনে দেখা যায়, মাস্ক কিংবা হ্যান্ড গ্লাভস ছাড়াই অবাধে ঘুরছে দ্বীপের বাসিন্দারা। দোকানপাট বন্ধ থাকলেও নেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। একে অপরের সঙ্গে আলাপ-চারিতা কিংবা দুষ্টুমিতে মেতে আছে। আবার বিভিন্ন স্থানে দলবেধে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের পশ্চিম বীচের বাসিন্দা জমির উদ্দিন বলেন, করোনা ভাইরাস নিয়ে রেডিওতে শুনছি বিশ্বে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু এখন আমরা কি করব। আমরা তো এটা হলে কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না।

আরেক বাসিন্দা ফরিদ উদ্দিন বলেন, দ্বীপের মানুষ হিসেবে আমাদের এখানে করোনা ভাইরাস আসবে। এখন বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটক কিংবা মানুষজন আসছে না। জাহাজগুলো বন্ধ। আল্লাহ রহমতে আমাদের কিছুই হবে না।

এদিকে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে কোন ধরণের প্রস্তুতি নেই সেন্টমার্টিন দ্বীপে। দ্বীপে ১০ শয্যার একটি হাসপাতাল থাকলেও নেই স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটিতে ৩টি ভবন রয়েছে। সেখানে কাউকে দেখা যায়নি। হাসপাতাল প্রাঙ্গণে গরু-ছাগল ও কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর হাসপাতালের গেইটটি খোলা রয়েছে।

দ্বীপের বাসিন্দা সিরাজ বলেন, এখানে হাসপাতাল থাকলেও কোন ডাক্তার কিংবা নার্স থাকে না। একজন ডাক্তার থাকলেও তিনি বাজারে ফার্মেসী খুলে বসে থাকেন। হাসপাতালে যান না। নার্সও মাঝে মধ্যে উধ্বর্তন কর্মকর্তারা আসলে যান।
এদিকে দ্বীপটি মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় কোনো আক্রান্ত ব্যক্তি অনুপ্রবেশের মাধ্যমে এটি ছড়ালে পরিণাম হবে ভয়াবহ বলে মনে করছেন সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নূর আহমদ।

নূর আহমদ জানান, সেন্টমার্টিন দ্বীপের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কোন আস্থা নেই। হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না থাকলেও যদি ডাক্তার থাকতো তাহলে মানুষের কিছুটা হলেও আস্থা থাকতো। কারণ হঠাৎ করে করোনা ভাইরাসের কোন আলামত দেখা দিলে অন্তত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারতো। তাই এটা নিয়ে আতংকে আছি।

তিনি আরও জানান, সেন্টমার্টিন দ্বীপের খুবই কাছাকাছি হচ্ছে মিয়ানমার। যদি মিয়ানমার থেকে কোন করোনা আক্রান্ত রোগী প্রবেশ করে তখন দ্বীপের মানুষের অবস্থা ভয়াবহ হবে। তাই দ্বীপে বাইরের কেউ যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে তার জন্য সীমান্তরক্ষী বাহিনী কঠোর হতে হবে বলেও জানান তিনি।

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়া এখানকার মানুষদের করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করতে ছুটে আসে নৌ-বাহিনীর জাহাজ বঙ্গবন্ধু, নিভয় ও নির্মূল।
বানৌজা-বঙ্গবন্ধু অধিনায়ক ক্যাপ্টেন তানজিম ফারুক জানাল, সীমান্তে সম্মিলিতভাবে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর পাশাপাশি করোনাভাইরাস সম্পর্কে দ্বীপবাসীকে সচেতন করা হচ্ছে।

বিশেষ করে, দ্বীপের অসহায় মানুষদের খাদ্য সহায়তা করার চেষ্টা করছি। যদি করোনা ভাইরাস আক্রান্ত কেউ পাওয়া যায় তাহলে নৌ-অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম পাঠানো হবে। এখানকার মানুষদেরকে আশ্বাস্ত করা হচ্ছে।’

উল্লেখ্য, সেন্টমার্টিন দ্বীপে ১৪’শ পরিবার থাকলেও করোনাভাইরাসের কারণে সহায়তা পেয়েছেন মাত্র দুইশ’ হতদরিদ্র মানুষ।