সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের পাহারায় ঢুকছে ইয়াবা

সমকাল •

ফাইল ছবি

সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপের পাহারায় মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান ঢুকছে দেশে। আগেভাগেই এই ব্যাপার ওই গ্রুপের সদস্যদের জানিয়ে দেয় মাদক কারবারিরা। এরপর মাদক কারবারিদের ‘এস্কর্ট’ দিয়ে দেশে আনা হয়। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা তাদের অস্ত্রসহ পাহারা দিয়ে সহায়তা করছে, টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছে তারা।

ইয়াবার চালান আনার পরপরই তা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নেওয়া হয়। সেখান থেকে এই চালান ভাগবাটোয়ারা করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হয়। সম্প্রতি একাধিক ইয়াবার চালান দেশে ঢোকার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তার পেছনে সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপ জড়িত থাকার এমন তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। সর্বশেষ গত সোমবার সন্ধ্যায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) দুই সদস্য আহত হয়েছেন গুলিতে। ইয়াবা পাচারকারীদের কাজ ছিল এটি। এ ঘটনায় জড়িত ছিল মাদক কারবারিদের সহায়তাকারী সশস্ত্র রোহিঙ্গারা। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, ‘সীমান্তে একটি সংঘবদ্ধ সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপ ইয়াবা কারবারিদের সহায়তা করে আসছে। তাদের দলনেতাকেও শনাক্ত করা হয়েছে। এই গ্রুপে ৩০-৪০ জন রয়েছে। শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় হবে। বিজিবির ওপর হামলায় সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপের মাদক কারবারিরা সম্পৃক্ত ছিল।’

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি গ্রুপ ইয়াবার কারবারে জড়িত। তাদের কেউ বড় চালান, আবার কেউ ছোট চালান আনছে। এরই মধ্যে অনেকে ধরাও পড়েছে।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তা জানান, যখন বড় ধরনের ইয়াবার চালান দেশে ঢোকে, তখন মাদক কারবারিরা ঝুঁকি নিতে চায় না। যে কোনো মূল্যে ইয়াবার চালান নিরাপদে খুচরা বিক্রেতার হাত পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চালায় তারা। এ কারণে বড় চালান দেশে ঢোকার আগেই তাদের পূর্বপরিচিত সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপের সদস্যদের জানায়। এরপর ওই গ্রুপের সদস্যরা সীমান্ত এলাকায় গিয়ে মাদক কারবারিদের পাহারা দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। সম্প্রতি গোয়েন্দা তথ্য ছিল, ২০ লাখ ইয়াবার একটি চালান দেশে ঢুকবে। ওই চালানের পাহারাদার হিসেবে ছয় থেকে আটজনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ থাকবে। বিজিবির ওপর হামলা চালিয়ে ওই গ্রুপের সদস্যরা নিরাপদে তাদের চালান নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকেছে। কখন কার মাধ্যমে কী প্রক্রিয়ায় ওই চালান ক্যাম্পে প্রবেশ করেছে, সে ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য এরই মধ্যে পেয়েছেন গোয়েন্দারা।’

সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, যারা বছরের পর বছর ধরে ইয়াবা কারবারে জড়িত, তাদের অনেকের সঙ্গে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গদের যোগাযোগ রয়েছে। মাদক কারবারিরা বড় ধরনের টোপ দিয়ে অনেক রোহিঙ্গাকে ইয়াবার কারবারে জড়িয়েছে। তাদের মধ্যে যারা মাদক কারবারি, তাদের অনেকের কাছে দেশি-বিদেশি অস্ত্র রয়েছে। মাদক কারবার ও মানব পাচার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রায়ই নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়াচ্ছে তারা। ক্যাম্প আধিপত্য নিয়েও প্রায়ই ঘটছে খুনোখুনি। কেউ কেউ জড়াচ্ছে অস্ত্র কারবারে। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাসহ সেখানকার নিরাপত্তা ঘিরে নতুনভাবে ভাবছে সরকার।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া পুরোনো রোহিঙ্গাদের মধ্যে কেউ কেউ বড় ইয়াবার কারবারি। ‘বাঙালি-রোহিঙ্গা’ মিলে যৌথভাবে তারা কারবার চালিয়ে আসছে। কক্সবাজার ছাড়াও রুট বদলে কুমিল্লা, পটুয়াখালী, সিলেট ও নাইক্ষ্যংছড়ি হয়ে ইয়াবা ঢুকছে।

একটি চক্র টাকার বিনিময়ে অন্য জায়গায় পাচার করছে রোহিঙ্গা নারীদের। এই চক্রের সদস্যরা ক্যাম্প ঘুরে যেসব রোহিঙ্গা নারী খুব অসহায়, তাদের প্রথমে ঢাকায় নিয়ে পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন জায়গায় চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেয়। আবার কোনো নারীকে বিদেশে নিয়ে চাকরি দেওয়ার কথাও জানায়। মিয়ানমারে যেসব রোহিঙ্গা নারী তাদের আত্মীয়-স্বজন হারিয়ে এতিম হয়ে কক্সবাজারের ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন, প্রথমে টার্গেট করা হয় তাদের। এরপর অন্য গ্রুপের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে কিছু সংঘবদ্ধ ডাকাত গ্রুপও রয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা বিদেশে অবস্থান করে অর্থ উপার্জন করছে, ক্যাম্পে তাদের পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করে মুক্তিপণ আদায় করাই তাদের কাজ। এই অপরাধে তারা একনলা বন্দুক ও কাটা রাইফেলও ব্যবহার করে থাকে।

জানা গেছে, মাদক কারবারের পাশাপাশি মানব পাচারে সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছে রোহিঙ্গাদের একাধিক গ্রুপ। ঢাকায় এনেই প্রথমে তাদের বাংলা শেখানোর কার্যক্রম শুরু করে মানব পাচারকারী চক্র। প্রত্যেকের হাতে তুলে দেওয়া হয় দেশের একেকটি এলাকার ভুয়া ঠিকানা সংবলিত কাগজ। সেই ঠিকানা তাদের মুখস্ত করতে বলা হয়। সেটা সম্পন্ন হলে পাচারকারী এই চক্রের অন্যতম প্রধান জনৈক আইয়ুব আকবার যোগাযোগ করে পাসপোর্ট অফিসের দালালের সঙ্গে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা নারীদের কোনো একটি এলাকায় নিয়ে তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া হয়। ভুয়া ঠিকানায় তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মসনদ সংগ্রহ করে দেয় এই চক্র।