পরিবেশগত সংকটাপন্ন সেন্টমার্টিন দ্বীপ

নেছার আহমদ :

পর্যটকদের অন্যতম দর্শণীয় স্থান দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র সহ পরিবেশ প্রকৃতি মারাত্বভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। ইতিমধ্যে পরিবেশগত নানা বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে নানা প্রাণী। পরিবেশ সংকটাপন্ন দ্বীপটিতে পর্যটনকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে শতাধিক অবৈধ হোটেল-গেস্ট হাউস। অতিরিক্ত পর্যটক এ দ্বীপের ভারসাম্যের জন্য হুমকি এবং জীববৈচিত্র ধ্বংস হচ্ছে বলে সম্প্রতি পরিবেশ সমীক্ষায় উঠে এসেছে। এর পুর্বে দ্বীপের জীববৈচিত্র রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে সরকার। প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এবং সংবেদনশীল এ দ্বীপকে পরিবেশগত বির্পয় থেকে রক্ষার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, স্বচ্ছ পানি ও চারপাশ জুড়ে প্রবাল পাথর বেষ্টিত মনোলোভা পুরো দ্বীপটিই যেন নৈস্বর্গিক। বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার সীমান্তের পার্শবর্তী ৮.৩ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত এ দ্বীপ। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন ক্ষেত্রও। সেন্টমার্টিনে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ক বা কড়ি-জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৫ প্রজাতির ডলফিন, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২ প্রজাতির বাদুড় সহ নানা প্রজাতির বসবাস ছিল। এসব প্রাণীর অনেকটাই এখন বিলুপ্তির পথে। জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন সময়ে দূষণের কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রাণী।

প্রায় ৯ হাজার মানুষের বসবাসরত প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের অপরূপ ও মোহনীয় সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে শীত মৌসুমে দেশী-বিদেশী পর্যটকে মুখরিত থাকে। দিনদিন বৃদ্ধি পায় পর্যটকদের বিচরণ। দ্বীপে প্রতিদিন ৬টি জাহাজ ৭ হাজারের অধিক পর্যটক নিয়ে যাতায়ত করে। প্রাকৃতিক প্রবাল দ্বারা আচ্ছাদিত এ দ্বীপে পর্যটকদের রাত্রিযাপনে ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে ১০৪টি আবাসিক হোটেল। পাশাপাশি খাবার হোটেল সহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব আবাসিক হোটেল এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মানে প্রাকৃতিক পাথর উত্তোলনের পাশাপাশি, গাছ-পালা কেটে ফেলা হয়েছে। এসব হোটেলে নেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এসব বর্জ্যরে পাশাপাশি সমুদ্রের পানিতে পড়ছে পর্যটকদের ব্যবহৃত নানা প্লাষ্টিক। এসব কারনে এ দ্বীপে পরিবেশগত নানা বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র। বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে নানা প্রাণী।

পর্যটনকে পুঁজি করে পরিবেশ সংকটাপন্ন দ্বীপটিতে বৃদ্ধি পেয়েছে জন সমাগম। তাই অতিরিক্ত পর্যটক এ দ্বীপের ভারসাম্যের জন্য হুমকি এবং জীববৈচিত্র ধ্বংস করছে বলে পরিবেশ সমীক্ষায় উঠে এসেছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের পাশে আরেকটা দ্বীপ ছেঁড়া দ্বীপ। দ্বীপের চারদিকে রয়েছে প্রবাল, পাথর, ঝিুনক, শামুকের খোলস, চুনা পাথর সহ প্রায় কয়েক শত প্রজাতির সামুদ্রিক জীব। জনশূন্য ছেঁড়া দ্বীপের অপরূপ দৃশ্য দেখতে কাঠের অথবা স্পীড বোটে ছুটে যাচ্ছে পর্যটকরা। এতে দিন দিন এ দ্বীপের জীববৈচিত্র, পরিবেশ প্রকৃতি মারাত্বভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এবং সংবেদনশীল এ দ্বীপকে পরিবেশগত বির্পয় থেকে রক্ষার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

বিশিষ্ঠ পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও আইইউসিএন এর সাবেক কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ইশতিয়াক উদ্দিন আহমদ জানান, সেন্টমার্টিন দ্বীপ পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা এবং সংবেদনশীল। এখানে যদি কোন রকম পরিবেশগত বা যে কোন কারনে বিপর্যয় হয় তাহলে এটি পুনর”দ্ধার করা কঠিন কাজ হবে। দ্বীপটিকে রক্ষা করার জন্য প্রাকৃতিক যে আবয়ব ছিল এগুলি যদি ব্যাহত হয় তাহলে দ্বীপের বিপর্যয় হবেই।

দ্বীপের বিভিন্ন উদ্ভিদরাজী সহ বহু প্রাণী ইতিমধ্যে বিনষ্ঠ হয়ে গেছে। সামুদ্রিক কাছিম সহ বিভিন্ন প্রাণী সেন্টমার্টিন ও ছেড়া দ্বীপে ডিম পাড়তে আসতো। জরিপ করে দেখা গেছে এর সংখ্যা মারাত্বকভাবে কমে গেছে। অতিরিক্ত মানুষ সমাগমের কারনে ডিম পাড়া সহ বিচরনের পরিবেশ না পায় তাহলে এসব প্রাণী দ্বীপে আসা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই প্রাকৃতিক যে অবয়ব ছিল সেটি যাতে আর বিনষ্ঠ করা না হয়। কৃত্রিমভাবে কিছু করতে গেলেই এখানে প্রাকৃতিকভাবে বিপর্যয় ঘটবে। এজন্য এখই যদি পদক্ষেপ নেয়া না হয় তাহলে বিপর্যয় ঠেকানো অত্যন্ত কষ্ঠসাধ্য ব্যাপার হবে।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো: সাইফুল আশ্রাব জানান, সেন্টমার্টিনে পর্যটক আগমন বৃদ্ধি পাওয়াকে পুজিঁ করে গত দুই দশকে এ দ্বীপে বহু হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠেছে অবৈধভাবে। গড়ে তুলেছে অনেক বহুতল ইমারত। এসবের একটিতেও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বা অনুমতি নেই। এসব স্থাপনা করতে গিয়ে পাথর উত্তোলনের পাশাপাশি সমুদ্র সৈকতের বালি আহরণ করা হয়েছে। এ দ্বীপে আগে তাল গাছ সহ অনেক উচু গাছপালা ও কেয়াবন ছিল, তাও কেটে স্থাপনা নির্মান করেছে অনেকে। জিও টেক্সটাইল দিয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মান করা হয়েছে। ব্যবসায়ীকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য এসব ব্যবসায়ীরা দ্বীপের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ঠ ক্ষুন্ন করা হচ্ছে। যার দর”ন পরিবেশ অধিদপ্তর বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়ে তাদের অবৈধ এসব কর্মকান্ড বন্ধ করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় স্থানিয়দের সচেতন করতে নানা প্রকার পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে। সেন্টমার্টিন জীববৈচিত্র উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প গঠন করে জীববৈচিত্র সংরক্ষনের জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
তিনি জানান, সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্থর খুবই পাতলা। এখানে অতিরিক্ত পর্যটক আগমনের কারনে পর্যটন মৌসুমে অতি মাত্রায় সূ-পেয় পানি উত্তোল করা হয়। যার দর”ন দ্বীপের উত্তরে অর্ধশতাধিক নলকূপে লবণাক্ত পানি দেখা দিয়েছে। এটি সেন্টমার্টিনের স্থানীয় বাসিন্ধাদের জীবনযাপনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো: কামাল হোসেন জানান, সেন্টমার্টিন দ্বীপ এবং দ্বীপের পরিবেশ প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র রক্ষা করা আমাদের খুবই দরকার। অতিরিক্ত পর্যটকদের নানা কর্মকান্ডের কারনে ইতিমধ্যে জীববৈচিত্র ও পরিবেশ প্রকৃতির অনেকটা ক্ষতি হয়ে গেছে। সেটা থেকে রক্ষার জন্য কত সংখ্যক পর্যটক প্রতিদিন যেতে পারবে, কিকি করা যাবেনা, রাত্রী যাপন নিষিদ্ধ করা সহ জীববৈচিত্র বা পরিবেশ প্রকৃতির ক্ষতিকর সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে পরিকল্পিত পরিবেশ বান্ধব পর্যটন শিল্প তৈরির দাবী স্থানিয়দের।