করোনাকালেও অপরাধের অভয়ারণ্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প

সরোয়ার আলম ও শহিদুল ইসলাম ◑

করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বাড়ছে নানা ধরনের অপরাধ। মাঝেমধ্যে ঘটছে হত্যাকান্ডের ঘটনাও। তাছাড়া ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ, হত্যা ও ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এসব ক্যাম্প ঘিরে। ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক কারবারও প্রকাশ্যে চলে ক্যাম্পের ভেতর।

আর ওইসব রোহিঙ্গার আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে ‘প্রভাবশালী’ একটি মহল; যাদের আশকারা পেয়ে তারা দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এদিকে গত দুই বছরে নানা অপরাধে জড়িত ৮৬ রোহিঙ্গা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। খবর দেশ রূপান্তর।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পুলিশের ব্যাপক নজরদারি আছে। কতিপয় রোহিঙ্গার নানা অপরাধে জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে বেশকিছু রোহিঙ্গা অপরাধী মারা গেছে। তিনি বলেন, কিছু রোহিঙ্গা ডাকাতির সঙ্গেও জড়িত। রোহিঙ্গা অপরাধীদের তালিকা আছে। তাদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বসবাস করছে সাড়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা।

প্রায় চার বছর ধরে তারা বাংলাদেশে বসবাস করছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার পর কয়েক মাস ভালো ছিল তাদের চালচলন। বছর তিনেক ধরে রোহিঙ্গারা মাদক কারবারসহ নানা অপরাধে জড়িয়েছে। পাশাপাশি অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় করার ঘটনাও ঘটাচ্ছে তারা। তাছাড়া উখিয়া-টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে শক্তিশালী ইয়াবা সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে। ইয়াবা বিক্রি করে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়েছে। ক্যাম্পের পাশেই সরকারি জায়গা দখল করে নিজ খরচে ‘আলিশান’ বাড়িও তৈরি করেছে। অভিযোগ আছে, বিভিন্ন ক্যাম্পের সহস্রাধিক রোহিঙ্গা মাদক কারবারসহ অন্যান্য অপরাধে জড়িত। তাদের সঙ্গে মিয়ানমারের নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোরও যোগাযোগ রয়েছে। রাতের আঁধারে মিয়ানমার থেকে মাদকের চালান সীমান্তের কাঁটাতারের পাশে বয়ে নিয়ে আসে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। পরে রোহিঙ্গাদের কাছে চলে আসে ওই চালান। সুযোগ বুঝে চিহ্নিত বাংলাদেশের সিন্ডিকেট সদস্যরা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করে দিচ্ছে। তবে সিন্ডিকেটের ‘গডফাদাররা’ থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরেই। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ‘প্রোফাইল’ তৈরি করেছে। তাদের কারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে সেই তালিকাও করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, ‘কতিপয় রোহিঙ্গা ইয়াবা, মাদক, অপহরণ, খুন, অস্ত্রসহ নানা অনৈতিক কাজে জড়িত। অন্তত দুই ডজন বাংলাদেশি সুবিধা নিয়ে রোহিঙ্গা অপরাধীদের সহায়তা করছে। তাদের তালিকাও আছে আমাদের কাছে। ’

অভিযোগ আছে, সম্প্রতি মুক্তিপণ দিতে না পারায় এক কৃষককে হত্যা করে রোহিঙ্গা ডাকাতরা। স্থানীয়রা বলছেন, রোহিঙ্গাদের কারণে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের। চলাফেরা করা কষ্টকর। ক্যাম্পের ভেতর মাদক কারবার চলে প্রকাশ্য। মিয়ানমার থেকে তারা ইয়াবার চালানও নিয়ে আসে। তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অভিযান জোরদার করতে হবে। নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে। রোহিঙ্গা অপরাধীদের তালিকা করে আইনের আওতায় আনতে হবে। আর না হয় তাদের অপরাধের মাত্রা বেড়েই যাবে।

স্থানীয়রা জানান, গত ২৯ এপ্রিল টেকনাফের মিনাবাজার শামসু হেডম্যানের ঘোনা এলাকায় ছয়জন কৃষক ধানক্ষেতে কাজ করা অবস্থায় সশস্ত্র একদল রোহিঙ্গা তাদের অপহরণ করে। অপহৃতরা হলেন আবুল হাশেম এবং তার দুই ছেলে জামাল ও রিয়াজউদ্দিন, মো. হোসেনের ছেলে শাহেদ, মৌলভী আবুল কাছিমের ছেলে আকতার উল্লাহ ও প্রয়াত মো. কাশেমের ছেলে ইদ্রিস। মুক্তিপণ হিসেবে চাল ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর বিনিময়ে হাশেম ও তার দুই ছেলেকে ছেড়ে দেয় রোহিঙ্গারা। বাকি তিনজনকে ছাড়েনি। অপহৃত শাহেদের মোবাইল ফোন থেকে তার পরিবারের কাছে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। দ্রুত মুক্তিপণ না দিলে তাকে মেরে ফেলার হুমকিও দেয় তারা। এরপর ১ মে সকালে অপহৃত আকতার উল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে রোহিঙ্গারা। চিহ্নিত রোহিঙ্গা ডাকাত হাকিম ওই কৃষকদের অপহরণ করায়। সেদিন স্থানীয়রা কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন।

বক্তারা বলেছেন, শিগগিরই রোহিঙ্গা ডাকাত হাকিমকে আটক করতে হবে। পরদিন টেকনাফ থানার ওসির নেতৃত্ব একদল পুলিশ ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় হাকিম ডাকাতের আস্তানায় অভিযান চালানো হয়। তবে তাকে পাওয়া যায়নি।

হোয়াইক্যং ইউপির চেয়ারম্যান নুর আহম্মদ আনোয়ারী বলেন, রোহিঙ্গা ডাকাতরা স্থানীয় ছয় ব্যক্তিকে অপহরণ করে। কৌশলে তিনজন ফিরে এলেও বাকিদের মুক্তিপণ ছাড়া ছেড়ে দেয়নি তারা। ইতিমধ্যে একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

অপহৃত অন্য দুই কৃষকের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।

হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মশিউর রহমান বলেন, ঘটনার পর থেকে টেকনাফ থানা পুলিশ ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

গত সপ্তাহে টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ জকির গ্রুপের সদস্য ডাকাত হাকিম ও ডাকাত রশিদ মারা যায়। এর আগে গত ২৮ এপ্রিল কক্সবাজারের রামু জোয়ারিয়া নালা এলাকায় ডিবি পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এক রোহিঙ্গা নিহত হয়।

তবে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যে ‘ডাকাত হাকিম’ নিহত হয়েছে সে আসল ডাকাত হাকিম নয় বলেই আমরা জানি। শুনেছি সে গহিন জঙ্গলে থাকে। তাকেসহ অন্য রোহিঙ্গা অপরাধীকে ধরতে আমরা অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করছি। তারা টেকনাফের একাধিক প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় থাকার কারণে কিছু করতে পারছি না।

উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা এখন বিষফোঁড়া। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এদের কারণে সামাজিক বিশৃঙ্খলা বাড়ছে।

টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, কতিপয় রোহিঙ্গা নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত আছে। তাদের তালিকা ধরে অভিযান চলছে। রোহিঙ্গা ডাকাত হাকিমকে ধরতে অভিযান জোরদার করা হয়েছে।