লাইব্রেরী, প্রতিষ্ঠান ও টেইলার্সের কাছে জিম্মি অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা

কক্সবাজারে শিক্ষাঙ্গনে রন্দে রন্দে কমিশন বাণিজ্য

সাইফুল ইসলাম,কক্সবাজার জার্নাল ◑ 

কক্সবাজার জেলা শহরসহ আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার নামকরা কেজি স্কুল-মাদ্রাসা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেন এক ধরনের ব্যতিক্রমী নির্যাতনের টর্চার সেলে পরিনত হয়েছে।

বিশেষ করে নতুন বই ক্রয়সহ ড্রেস সেলাই কাজে প্রতিনিয়তই হিমশিম খাচ্ছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। পাশাপাশি কোচিং বাণিজ্যতো আছেই। সর্বত্র এমন অভিযোগ সচেতন মহলের।

অভিযোগ রয়েছে, এখানে শাসনের নামে শিক্ষাার্থীরা শারীরিক-মানসিক নির্যাতন এবং অভিভাবকরা নানাভাবে হয়রানি ও অপমানের শিকার হচ্ছেন।

গতকাল সরেজমিন বেশ কয়েকটি স্কুল ঘুরে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে আলাপে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের মতে, এসব প্রতিষ্ঠানে প্রভাবশালী ব্যক্তির সন্তানের সংখ্যাই বেশি। অথচ দরিদ্র অভিভাবকেরা ইচ্ছা থাকলেও ওইসব প্রতিষ্ঠানে দেয়ার কোন সুযোগ থাকেনা।

শিক্ষার্থী-অভিভাবক সূত্রে জানা যায়, স্কুলের বই, ড্রেস, ট্রাই, টুপি ও সোল্ডার-সহ যাবতীয় জিনিসেই কমিশন ভিত্তিক হচ্ছে। নতুন বই ক্রয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের বই শুধু একটি লাইব্রেরীতেই পাওয়া যায়। কেননা ওই লাইব্রেরীর সাথে উক্ত প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয়ে থাকে। সেজন্য স্কুলের নাম বললেই ওই লাইব্রেরীতে সেট করা বই দিয়ে দেয়। এমনিক বইয়ের আলাদা হিসেবে করতে হয় না। তালিকায় ১ সেট বইয়ের মূল্য কত তা লিখা রয়েছে। এভাবে ড্রেস সেলাইয়ের টেইলার্সের কাছে গেলেই একই অবস্থা। তাও স্কুল ও টেইলার্সের মধ্যে একটি চুক্তি হয়ে থাকে। একেক প্রতিষ্ঠানে একেকটি ড্রেসের কাপড় স্টক রয়েছে। অভিভাবকরা ড্রেস সেলাই ও লগুর কথা জিজ্ঞাস করলেই শিক্ষককেরা বলেন, ওমুক টেইলার্সে যাও ওখানে আমাদের স্কুলের ড্রেসের কালার ও লগু রয়েছে। বাকী ট্রাই, টুপি সোল্ডার নিতে হয় স্ব-স্ব স্কুল থেকে। শুধু তাই নয়, কোচিং বাণিজ্যই চলছে বেপরোয়াভাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কক্সবাজার শহরের নামকরা প্রতিষ্ঠান শহীদ তিতুমীর ইনস্টিটিউটের নতুন বই ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি রয়েছে মোহাম্মদীয়া লাইব্রেরীর সাথে, ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সাথে চুক্তি রয়েছে রহমানিয়া লাইব্রেরী ও মোহাম্মদীয়া লাইব্রেরীর সাথে। এভাবেই প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে লাইব্রেরীর কমিশন ভিত্তিক চুক্তি রয়েছে বলে জানা গেছে।

পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা কমিটির সভাপতিসহ অধিকাংশই সদস্য এ শ্রেণীর প্রতিনিধি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের (প্রভাবশালী) স্ত্রী-সন্তানেরা যোগ দেন শিক্ষক হিসেবে। এ ধরনের ব্যক্তিদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ শিক্ষককেরা। এছাড়াও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আরও অভিযোগ, শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে অমানুষের মতো আচরণ করেন ওইসব শিক্ষক।

শুধু তাই নয়, কথায় কথায় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের ফি বৃদ্ধি, ক্লাসে ঠিকমতো না পড়ানো, কোচিংয়ে বাধ্য করা, ভর্তি ও গাইড বাণিজ্য, প্রতিষ্ঠানে তহবিল-সহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকেরা। পরিচালনা কমিটি ও শিক্ষকদের সঙ্গে যোগসাজসে তারা লুটপাটে লিপ্ত হন।

জানা গেছে, এ কক্সবাজার শহরের বেশির ভাগ স্কুলেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতি এবং শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের নানাভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেপরোয়া দুর্নীতিতে অভিভাবক ও শিক্ষার্থী রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছেন। সন্তানকে মানসিক নির্যাতন করা হয় বলে কোনো অভিভাবক প্রতিবাদের সাহসও করেন না। সন্তানের দিকে তাকিয়ে মুখ বুঝে সব সহ্য করেন তারা।

সরেজমিন পরিদর্শনকালে ক্ষুব্দ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানান, ছেলেমেয়ে জন্ম দেয়ার পর তাদের মানুষের মতো মানুষ করে তুলতে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। ভর্তির পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধার্যকৃত অর্থ জোগান দিতেই ফতুর হওয়ার অবস্থা। তাদের কাছে মাসিক বেতন, পুনঃভর্তি, নতুন ভর্তি, ভর্তি ফরম, কোচিং ফি, প্রগতি বিবরণী, মার্কশিট, ছাড়পত্র, প্রত্যয়ন পত্র, খেলাধুলা, স্কাউট, গার্লস গাইড, দরিদ্র তহবিল, পাঠাগার, সিলেবাস, বিজ্ঞানাগার, কম্পিউটার, প্রযুক্তি ফি, স্কুলের নির্ধারিত নোট বই, গাইড বই, খাতা বাবদ, ডায়েরি বাবদ, পরিচয়পত্র বাবদ, পিকনিক, ঈদ পুনর্মিলনী-সহ অনেক ধরণের খাতের কথা জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ শহীদুল আজম বোর্ড বইয়ের বিষয়ে অবগত থাকার কথা স্বীকার করলেও বাকি অভিভাবক ও শিক্ষার্থী হয়রানীর বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান। তবে কারো বিরুদ্ধে সু-স্পষ্ট অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন এই শিক্ষা কর্মকর্তা।