কক্সবাজারে করোনা আক্রান্ত বৃদ্ধা মহিলার সব থেকেও যেন কেউ নেই

তোফায়েল আহমেদ,কালের কন্ঠ ◑

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের ৫০১ নম্বর কেবিনে চিকিৎসাধীন সৌদিফেরত করোনা আক্রান্ত বৃদ্ধ নারীর ধারে কাছেও কেউ নেই। কেউ নেই তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে নিয়ে যাবারও। এমন কোনো স্বজন নেই কেউ একমুঠো ভাত নিয়ে খাওয়াবে বৃদ্ধাকে। সন্তান-সন্তুতিদের সবাই কোয়ারেন্টিনে থাকায় আক্রান্ত এই হতভাগির দিকে কেউই হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন না। তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে- তার এক কন্যা এ পর্যন্ত সঙ্গে রয়েছেন। তবুও আজ বুধবার প্রায় পুরোদিনই না খেয়ে কাটিয়েছেন তিনি।

এ যেন চীনের উহান শহর সহ বিশ্বের অন্যান্য করোনা আক্রান্ত এলাকার নানা মানবিক কাহিনীর মতোই একটি। অথচ করোনা আক্রান্ত বৃদ্ধা মোসলেমা খাতুনের (৭০) রয়েছেন পাঁচ পুত্র ও চার কন্যার বিশাল আপনজনের বহর। বৃদ্ধার পাঁচ পুত্র সন্তান সবাই সমাজে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে দুই পুত্র শিক্ষাবিদ, এক পুত্র ব্যাংকার ও অপর দুই পুত্র একটি বেসরকারি কম্পানির পদস্থ কর্মকর্তা।

অপরদিকে চার কন্যারও সবাই গৃহবধূ। কিন্তু সবাই ‘করোনা পরিস্থিতি’র শিকার হওয়ার কারণে তাদের মা বঞ্চিত হচ্ছেন সেবা শুশ্রুষা থেকে।

এক পুত্র ছাড়া ৮ ভাই-বোনই গত ১৩ মার্চ সৌদি আরব থেকে তাদের মা (মোসলেমা) দেশে ফিরে আসার পর থেকেই সঙ্গে রয়েছেন। অপর এক ভাই রয়েছেন ঢাকায়। তিনিও করোনা পরিস্থিতিতে আটকা পড়েছেন। মা’র সঙ্গে মেলামেশার কারণে ৮ ভাই-বোনের মধ্যে ৭ জনের পরিবারই বর্তমানে রয়েছেন স্ব স্ব হোম কোয়ারেন্টিনে। তাদের মধ্যেও ব্যতিক্রম রয়েছেন এক বোন শায়েরা।

তিনি সেই থেকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তার মাকে জড়িয়ে ধরে রয়েছেন কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের ৫০১ নম্বর কেবিনে। মা ‘ভয়ংকর করোনা’য় আক্রান্ত। তবুও কন্যা শায়েরা এতটুকুও ভীত নন। তিনি মা’র সঙ্গেই একাকী রয়েছেন কেবিনটিতে।

গত ১৮ মার্চ কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে সর্দি-কাশি ও জ্বর নিয়ে সৌদিফেরত মোসলেমাকে ভর্তির পর থেকেই অদম্য সাহসী এবং মা ভক্ত কন্যা শায়েরা মাকে ছেড়ে যাননি। অথচ মঙ্গলবার ঢাকার আইইডিসিআর থেকে আসা নমুনা করোনা পজেটিভ চাওর হবার সঙ্গে সঙ্গেই স্বজনরা সবাই যার যার মতো করে সরে গিয়ে কোয়ারেন্টিনে চলে যান। এ কারণে একমাত্র কন্যা শায়েরা ছাড়া হাসপাতালে বৃদ্ধাকে দেখভাল করারও কেউ নেই। ফলে গতকাল পুরোদিন ধরেই না খেয়েই থাকতে হয় তাদের মা মোসলেমা ও কন্যা শায়েরাকে।

এ বিষয়ে করোনা আক্রান্ত বৃদ্ধার জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সোলেমান বলেন- ‘কলেজের একজন পিয়নকে আমি ভাত নিয়ে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু ৫০১ নম্বর কেবিনে খাবার নিয়ে যাবার কথা শুনেই হাসপাতাল কর্মচারী কর্তৃক পিয়ন বাধার মুখে ফিরে আসে। ফলে আমার মা ও বোন না খেয়ে থেকেছেন।’

শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার দিকে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন হোটেল থেকে এনে ভাত খাইয়েছেন করোনা আক্রান্ত বৃদ্ধাকে।

এ বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক বলেন-‘সারাদিন কেউ ভাত নিয়ে না আসার কথা জানতে পেরে আমি নিজেই হোটেল থেকে এনে খাবার ব্যবস্থা করেছি। আমি বৃদ্ধার স্বজনদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগও করেছি, তারা বলেছেন সবাই কোয়ারেন্টিনে।’

তিনি বলেন, করোনা আক্রান্ত বৃদ্ধা মোসলেমা খাতুনকে ১৮ মার্চ ভর্তি করার সময় পরিবারের সদস্যরা সত্য গোপন করায় যত ঝামেলা হচ্ছে। স্বজনরা একবারের জন্যও স্বীকার করেননি-আক্রান্ত বৃদ্ধা ওমরা থেকে ফিরে আসার কথা।

তত্ত্বাবধায়ক ডা. মহিউদ্দিন আরো বলেন, চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে মোসলেমা খাতুনকে নিয়ে যাবার জন্য স্বজনদের কেউ এগিয়ে আসছেন না। এমনকি তিনি নিয়ে যাবার জন্য যানাবাহনের ব্যবস্থা করার কথা বললেও এগিয়ে আসছেন না কেউ।

কক্সবাজার সরকারি মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. আবু মোহাম্মদ শামসুদ্দিন জানান- ‘বর্তমান অবস্থায় করোনা আক্রান্ত রোগী মোসলেমা অনেকটাই ভালো রয়েছেন। মঙ্গলবার তার পাতলা পায়খানা হলেও এখন সেটাও সেরে উঠেছে।’

তবে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এ রোগীর সঙ্গে মেলামেশাসহ চিকিৎসা কাজে জড়িত চিকিৎসক ও নার্সদের নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন।